গৃহদাহ

তাহার সাহস দেখিয়া সুরেশ অভিভূত হইয়া গেল। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত-হৃদয়ে কি একটা বলিবার উপক্রম করিতেই দেখিতে পাইল, মহিম তাহার বাহিরের কাজ সারিয়া বাড়ি ঢুকিতেছে। অচলা তখন পর্যন্ত ব্যাগটা সম্মুখে লইয়া মেঝের উপর বসিয়া এই দিকে পিছন ফিরিয়া ছিল; পাছে মহিমের আগমন জানিতে না পারিয়া আরও কিছু বলিয়া ফেলে, এই ভয়ে যে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া বলিয়া উঠিল, এই যে মহিম, কাজ সারা হল তোমার?

হাঁ হল, বলিয়া মহিম ঘরে পা দিয়াই অচলাকে তদবস্থায় নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ও কি হচ্ছে?

অচলা ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়া সুরেশকেই লক্ষ্য করিয়া পূর্ব-প্রসঙ্গের সূত্র ধরিয়া কহিল, আপনি আমারও ত বন্ধু—শুধু বন্ধুই বা কেন, আমাদের যা করছেন, তাতে আপনি আমার পরমাত্মীয়। এমন করে চলে গেলে আমার লজ্জার, ক্ষোভের সীমা থাকবে না। আজ আপনাকে ত আমি কোনমতেই ছেড়ে দিতে পারব না।

সুরেশ শুষ্ক হাসিয়া কহিল, শোন কথা মহিম! তোমাদের দেখতে এসেছিলুম, দেখে গেলুম বাস্‌! কিন্তু এ জঙ্গলের মধ্যে আমাকে অনর্থক বেশিদিন ধরে রেখে তোমাদেরই বা লাভ কি, আর আমারই বা সহ্য করে ফল কি বল?

মহিম ধীরভাবে জবাব দিল, বোধ করি রাগ করে চলে যাচ্ছিলে; কিন্তু সেটা উনি পছন্দ করেন না। অচলা তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, তুমি পছন্দ কর নাকি?

মহিম জবাব দিল, আমার কথা ত হচ্ছে না।

সুরেশ মনে মনে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। তার এই অপ্রিয় আলোচনা কোনমতে থামাইয়া দিবার জন্য প্রফুল্লতার ভান করিয়া সহাস্যে কহিল, এ কি মিথ্যে অপবাদ দেওয়া! রাগ করব কেন হে, আচ্ছা লোক ত তোমরা! বেশ, খুশিই যদি হও, আরও দু-একদিন না হয় থেকেই যাবো। বৌঠান, কাপড়গুলো আর তুলে কাজ নেই, বের করেই ফেলো। মহিম, চল হে, তোমাদের পুকুর থেকে আজ স্নান করেই আসা যাক; তার পরে বাড়ি গিয়ে না হয় একশিশি কুইনিনই গেলা যাবে।

চল, বলিয়া মহিম জামা-কাপড় ছাড়িবার জন্য ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

যাহারা নূতন জুতার সুতীক্ষ্ণ কামড় গোপনে সহ্য করিয়া বাহিরে স্বচ্ছন্দতার ভান করে, ঠিক তাহাদের মতই সুরেশ সমস্ত দিনটা হাসিখুশিতে কাটাইয়া দিল; কিন্তু আর একজন, যাহাকে আরও গোপনে এই দংশনের অংশ গ্রহণ করিতে হইল, সে পারিল না।

স্বামীর অবিচলিত গাম্ভীর্যের কাছে এই কদাকার ভাঁড়ামিতে, এত বেহায়াপনায় তাহার ক্ষোভে অপমানে মাথা খুঁড়িয়া মরিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। তাঁহাকে সে আজও হৃদয়ের দিক হইতে চিনিতে না পারিলেও বুদ্ধির দিক হইতে চিনিয়াছিল। সে স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, এই তীক্ষ্ণ-ধীমান অল্পভাষী লোকটির কাছে এ অভিনয় একেবারেই ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে, অথচ লজ্জার কালিমা প্রতি মুহূর্তেই যেন তাহারি মুখের উপর গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছে। আজ সকালবেলার পরে মহিম আর বাটীর বাহির হয় নাই; সুতরাং দিনের বেলায় ভাত খাওয়া হইতে শুরু করিয়া রাত্রির লুচি খাওয়া পর্যন্ত প্রায় সমস্ত সময়টাই এইভাবে কাটিয়া গেল।

অনেক রাত্রি পর্যন্ত বিছানার উপর ছটফট করিয়া অচলা ধীরে ধীরে কহিল, সারারাত্রি আলো জ্বেলে পড়লে আর একজন ঘুমোতে পারে না। তোমার কাছে এটুকু দয়াও কি আর আমি প্রত্যাশা করতে পারিনে?

তাহার কণ্ঠস্বরে মহিম চমকিয়া উঠিয়া এবং তাড়াতাড়ি বাতিটা নামাইয়া দিয়া কহিল, অন্যায় হয়ে গেছে, আমাকে মাপ করো। বলিয়া বই বন্ধ করিয়া আলো নিবাইয়া দিয়া শয্যায় আসিয়া শুইয়া পড়িল। এই প্রার্থিত অনুগ্রহলাভের জন্য অচলা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল না, কিন্তু ইহা তাহার নিদ্রার পক্ষেও লেশমাত্র সাহায্য করিল না। বরঞ্চ যত সময় কাটিতে লাগিল, এই নিঃশব্দ অন্ধকার যেন ব্যথায় ভারী হইয়া প্রতি মুহূর্তেই তাহার কাছে দুঃসহ হইয়া উঠিতে লাগিল। আর সহিতে না পারিয়া এক সময়ে সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, সংসারে ভুল করলেই তার শাস্তি পেতে হয়, এ কথা কি সত্যি?

মহিম অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিল, অভিজ্ঞ লোকেরা তাই ত বলেন।

অচলা পুনরায় কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, তবে যে ভুল আমরা দু’জনেই করেছি, যার কুফল গোড়া থেকেই শুরু হয়েচে, তার শেষ ফলটা কি-রকম দাঁড়াবে, তুমি আন্দাজ করতে পারো?

মহিম কহিল, না।

অচলা কহিল, আমিও পারিনে। কিন্তু ভেবে ভেবে আমি এটুকু বুঝেছি যে, আর সমস্ত ছেড়ে দিলেও শুধু পুরুষমানুষ বলেই এই শাস্তির বেশি ভার পুরুষের বহা উচিত।

মহিম বলিল, আরও একটু ভাবলে দেখিতে পাবে, মেয়েমানুষের বোঝা তাতে এক তিল কম পড়ে না। কিন্তু পুরুষটি কে? আমি, না সুরেশ?

অচলা যে শিহরিয়া উঠিল, অন্ধকারের মধ্যেও মহিম তাহা অনুভব করিল।

ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অচলা ধীরে ধীরে কহিল, তুমি যে একদিন আমাকে মুখের ওপরেই অপমান করতে শুরু করবে, এ আমি ভেবেছিলুম। আর এও জানি, এ জিনিস একবার আরম্ভ হলে কোথায় যে শেষ হয়, তা কেউ বলতে পারে না; কিন্তু আমি ঝগড়া করতেও পারব না, কিংবা বিয়ে হয়েচে বলেই ঝগড়া করে তোমার ঘর করতেও পারব না। কাল হোক, পরশু হোক, আমি বাবার ওখানে ফিরে যাবো।

মহিম কহিল, তোমার বাবা কিন্তু আশ্চর্য হবেন।

অচলা বলিল, না। তিনি জানতেন বলেই আমাকে বারংবার সাবধান করবার চেষ্টা করেছিলেন যে, এর ফল কোনদিন ভাল হবে না। কলকাতায় চলে, কিন্তু পল্লীগ্রামে সমাজ, আত্মীয়, বন্ধু সকলকে ত্যাগ করে শুধু স্ত্রী নিয়ে কারও বেশি দিন চলে না। সুতরাং তিনি আর যাই হোন, আশ্চর্য হবেন না।

মহিম কহিল, তবে তাঁর নিষেধ শোনোনি কেন?

অচলা প্রাণপণ-বলে একটা উচ্ছ্বসিত শ্বাস দমন করিয়া লইয়া কহিল, আমি ভাবতুম, তুমি কিছুই না বুঝে কর না।

সে ধারণা ভেঙ্গে গেছে?

হাঁ।

তাই ভাগের কারবারে সুবিধে হলো না টের পেয়ে দোকান তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছো?

হাঁ।

35 Shares