গৃহদাহ

সুরেশের দুই চোখ ছলছল করিতে লাগিল। বাষ্পরুদ্ধ-স্বরে বলিল, কাল থেকে এই ভয়ে আমার শান্তি নেই মহিম।

মহিম নীরবে শুধু একটু তাহার হাতের মধ্যে চাপ দিল। তাহার পরে কহিল, সুরেশ, একটা সত্যকার অপরাধ অনেক মিথ্যা অপরাধের বোঝা বয়ে আনে। কিন্তু অনেক দুঃখ পেয়ে তুমি যাই কর না কেন, যাকে ‘ক্রাইম’ বলে, সে তুমি কোনদিন করতে পার না বলে আজও আমি বিশ্বাস করি। একটুখানি থামিয়া কহিল, সুরেশ, তুমি ভগবান মানো না বটে, কিন্তু যে যথার্থ মানে সে অহর্নিশি প্রার্থনা করে, এ বিশ্বাস তিনি যেন তার না ভেঙ্গে দেন।

ট্রেন আসিয়া পড়িল। মেয়েদের গাড়িতে অচলা এবং তাহার দাসীকে তুলিয়া দিয়া মহিম সুরেশের কাছে আসিতেই সে জানালা দিয়া হাত বাড়াইয়া তাহার ডান হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, তোমার কালকের ক্ষতিটা পূর্ণ করে দেবার প্রার্থনাটা আমার কিছুতেই মঞ্জুর করলে না, কিন্তু তোমার ভগবান তোমার প্রার্থনা যেন মঞ্জুর করেন ভাই। আমাকে যেন আর তিনি ছোট না করেন, বলিয়াই সে হাত ছাড়িয়া দিয়া মুখ ফিরাইয়া বসিল।

ওদিকে জানালায় মুখ রাখিয়া অচলা যদুর সঙ্গে এতক্ষণ চুপি চুপি কি কথা কহিতেছিল, মহিম নিকটে আসিতেই জিজ্ঞাসা করিল, মৃণালদিদির স্বামী নাকি আজ মারা গেছেন?

মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ঘণ্টা-খানেক পূর্বে মারা গেছেন শুনলাম।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, প্রায় দশ-বারোদিন ধরে নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। এ খবরটাও আমাকে দেওয়া কোনদিন তুমি আবশ্যক মনে করোনি?

মহিম জবাব দিতে চাহিল, কিন্তু কি করিয়া কথাটা গুছাইয়া বলিবে, ভাবিতে ভাবিতেই বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

একবিংশ পরিচ্ছেদ

তখনও কেদারবাবু আগেকার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পান নাই। খাওয়া-দাওয়ার পরে আসিয়া বারান্দায় একখানা ইজি-চেয়ারে পড়িয়া খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে হয়ত একটু তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলেন, দরজায় ঠিকা গাড়ির কঠোর শব্দে চোখ মেলিয়া দেখিলেন, সুরেশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার কন্যা ও ঝি অবতরণ করিল। ঘুমের ঝোঁক তাঁহার নিমিষে উড়িয়া গেল; কি একটা অজ্ঞাত শঙ্কায় শশব্যস্তে উঠিয়া পড়িয়া গলা বাড়াইয়া চিৎকার করিলেন, অচলা যে? সুরেশ, তুমি কোথা থেকে? কি, ব্যাপার কি? এ-সব কি কাণ্ড-কারখানা, আমি ত কিছু বুঝতে পারিনে!

অচলা উঠিয়া আসিয়া পিতার পদধূলি গ্রহণ করিল। সুরেশ প্রণাম করিয়া কহিল, মহিমের টেলিগ্রাফ পাননি?

কেদারবাবু উদ্বিগ্নমুখে কহিলেন, কৈ, না!

সুরেশ একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিয়া বলিল, তা হলে হয় সে টেলিগ্রাফ করতে ভুলেছে, না হয় এখনো এসে পৌঁছায় নি।

কেদারবাবু কহিলেন, টেলিগ্রাফ যাক, ব্যাপার কি, তাই আগে বল না! তুমি এদের কোথা থেকে নিয়ে এলে?

সুরেশ বলিল, কাল রাত্রিতে আগুন লেগে মহিমের বাড়ি পুড়ে গেছে।

বাড়ি পুড়ে গেছে? সর্বনাশ! বল কি—বাড়ি পুড়ে গেল? কেমন করে পুড়ল? মহিম কৈ? তুমি এদের পেলে কোথায়? এক নিশ্বাসে এতগুলা প্রশ্ন করিয়া কেদারবাবু ধপ্‌ করিয়া তাঁহার ইজি-চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।

সুরেশ বলিল, এদের সেখান থেকেই নিয়ে আসচি। আমি সেখানেই ছিলাম কিনা।

কেদারবাবুর মুখ অত্যন্ত অপ্রসন্ন এবং গম্ভীর হইয়া উঠিল, কহিলেন, তুমি ছিলে সেখানে? কবে গেলে, আমি ত কিছু জানিনে। কিন্তু সে কৈ?

সুরেশ বলিল, মহিম ত আসতে পারছে না, তাই—

তাঁহার গম্ভীর মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না না, এ-সব ভাল কথা নয়। অতিশয় মন্দ কথা। যৎপরোনাস্তি অন্যায়। এ-সব ত আমি কোনমতেই—, বলিতে বলিতে তিনি চোখ তুলিয়া কন্যার মুখের প্রতি চাহিলেন।

অচলা এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিঠে হাত রাখিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া ছিল। পিতার এই সংশয় তাহার মর্মে গিয়া বিঁধিল। তাহার এই অকস্মাৎ আগমনের হেতু যে তিনি লেশমাত্র বিশ্বাস করেন নাই, তাহা সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়া লজ্জায় ঘৃণায় তাহার মুখে আর রক্তের চিহ্ন রহিল না।

কেদারবাবু এখানে ভুল করিলেন। মেয়ের মুখের চেহারায় তাঁহার সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হইল। আরাম-চেয়ারটায় হেলিয়া পড়িয়া হাতের কাগজখানা মুখের উপরে টানিয়া নিয়া ফোঁস করিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, যা ভাল বোঝ তোমরা কর। আমি কালই বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও চলে যাবো।

সুরেশ ক্রুদ্ধ-বিস্ময়ের সহিত কহিল, এ-সব আপনি কি বলচেন কেদারবাবু? আপনি বা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন কেন, আর হয়েছেই বা কি? বলিয়া সে একবার অচলার প্রতি একবার তাহার পিতার প্রতি চাহিতে লাগিল; কিন্তু কাহারও মুখ তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না।

কেদারবাবুর কাছে কোন জবাব না পাইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, যাক, আমার ওপর মহিম যা ভার দিয়েছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন। আমার নাওয়া-খাওয়া এখনো হয়নি, আমি বাড়ি চললুম। বলিয়া সে কয়েক পদ দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেই কেদারবাবু উঠিয়া বসিয়া ক্লান্তকণ্ঠে কহিলেন, আহা, যাও কেন ছাই।ব্যাপারটা কি, তবু শুনিই না। আগুন লাগল কি করে?

সুরেশ অভিমান-ভরে বলিল, তা জানিনে।

তুমি গেলে কবে সেখানে?

দিন পাঁচ-ছয় পূর্বে। আমি খাইনি এখনো, আর দেরি করতে পারিনে, বলিয়া পুনরায় চলিবার উপক্রম করিতেই কেদারবাবু বলিয়া উঠিলেন, আহা-হা, নাওয়া-খাওয়া ত তোমাদের কারও হয়নি দেখচি, কিন্তু জলে পড়নি এটাও ত বাড়ি, এখানেও ত চাকরবাকর আছে। অচলা, ডাকো না একবার বেয়ারাটাকে—দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোস, বোস, সুরেশ, ব্যাপারটা কি হলো, খুলেই সব বল শুনি।

সুরেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, রাত্রে ঘুমুচ্চি, মহিমের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দেখি, সমস্ত ধুধু করে জ্বলছে; খড়ের ঘর, নিবোবার উপায়ও ছিল না, সে বৃথা চেষ্টাও কেউ করলে না—সর্বস্ব পুড়ে গেল আর কি!

কেদারবাবু লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন, বল কি হে, সর্বস্ব পুড়ে গেল? কিছুই বাঁচাতে পারা গেল না? অচলার গয়নাপত্রগুলো?

35 Shares