গৃহদাহ

সেগুলো বেঁচেচে।

তবু রক্ষে হোক! বলিয়া বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তবু, কি করে আগুনটা লাগল?

সুরেশ কহিল, বললুম ত আপনাকে, সে খবর এখনো জানা যায়নি। তবে গ্রামের মধ্যে বড় কেউ আর তার শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, তা জেনে এসেছি।

নেই বুঝি?

না।

কেদারবাবু আর কোন কথা কহিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিয়া পরিশেষে আর একটা গভীর নিঃশ্বাস মোচন করিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, যাও, স্নান করে এসো গে সুরেশ, আর বেলা করো না। দেখি, রান্না-বান্নার কি যোগাড় হচ্ছে। বলিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

আহারাদির পরেও তিনি সুরেশকে মুক্তি দেন নাই। সে একটা আরাম-চৌকির উপরে অর্ধনিদ্রিতাবস্থায় পড়িয়া ছিল। অচলাও সেই যে স্নানান্তে তাহার ঘরে গিয়া খিল দিয়াছিল, আর তাহার কোন সাড়াশব্দ ছিল না। বিশ্রাম ছিল না শুধু কেদারবাবুর। এখন যে টেলিগ্রাম আসা না আসার বিশেষ কোন সার্থকতা ছিল না, তাহারই জন্য সমস্ত বেলাটা ছটফট করিয়া, সন্ধ্যার সময় অসময়ে ঘুমানো উচিত নয়, এই অজুহাতে মেয়েকে ডাকাইয়া পাঠাইয়া, প্রথমেই বলিয়া উঠিলেন, তোমরা যে বললে, সে টেলিগ্রাম করেচে—কৈ তার ত কিছুই দেখিনে। তোমরা ট্রেনেতে এসে পড়লে, আর তারের খবর এতক্ষণেও পৌঁছল না। আচ্ছা, দাঁড়াও ত দেখি, বলিয়া মেয়ের মুখের জবাব না শুনিয়াই চটিজুতা ফটফট করিতে করিতে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেলেন এবং ক্ষণকাল পরেই নীচে হইতে তাঁহার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনা যাইতে লাগিল। অচলার দাসীকে ধরিয়া তিনি নানাপ্রকারে জেরা করিতেছেন, এবং প্রত্যুত্তরে সে আশ্চর্য হইয়া বারংবার প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছে, সে কি বাবু, আগুন লেগে ঘরদোর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, চক্ষে দেখে এলুম, আর আপনি বলছেন, পোড়েনি! আর আগুন যদি না-ই লাগবে, তবে ঘরদোর পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল কি করে, একবার বিবেচনা করে দেখুন দেখি!

সুরেশ সমস্তই শুনিতেছিল; সে মাথা তুলিয়া দেখিল, অচলা চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া পাংশু-মুখে কান পাতিয়া প্রত্যেক কথাটি গিলিতেছে। শুষ্ক উপহাসের ভঙ্গিতে কহিল, তোমার বাবার হল কি, বলতে পারো?

অচলা চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, না।

সুরেশ কহিল, আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি উনি বিশ্বাস করেন নি। ওঁর ধারণা, আগুন লাগার গল্পটা আমাদের আগাগোড়া বানানো। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সত্যি-মিথ্যে একদিন টের পাবেনই, কিন্তু ওঁর সন্দেহটা এমন যে, এখানে আসা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে উঠেচে।

অচলা শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আর আসবেন না?

সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বোধ করি সম্ভব নয়। আমারও ত কিছু আত্মসম্মান বোধ আছে। কোন লোককে দিয়ে আমার ব্যাগটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো।

অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা। কিন্তু তাহার এখানে আসা না-আসার সম্বন্ধে কোন কথা কহিল না।

তা হলে কাল সকালেই দিয়ো। অনেক দরকারী জিনিস আমার ওর মধ্যে আছে, বলিয়া সে কেদারবাবুর জন্যে অপেক্ষা না করিয়াই বাহির হইয়া গেল।

কেদারবাবু ফিরিয়া আসিয়া কিছু আশ্চর্য হইলেন বটে, কিন্তু মনে মনে যে অপ্রসন্ন হইয়াছেন, তাহা বোধ হইল না।

রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত শয্যার উপর ছটফট করিয়া অচলা উঠিয়া পড়িল। তাহার ইচ্ছা, বাহিরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া সম্মুখের রাজপথের উপর লোকচলাচলের প্রতি চাহিয়া কিছুক্ষণের জন্যেও অন্যমনস্ক হয়।

তাহার ঘরের ও-দিকের কবাট খুলিয়া সে বারান্দায় আসিয়া দেখিল, তখনও বসিবার ঘরে আলো জ্বলিতেছে। প্রথমে মনে করিল, চাকরেরা গ্যাস বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর হইতেই ভিতর হইতে তাহার পিতার কণ্ঠস্বর কানে আসিতে তাহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। চিরদিন তিনি দশটা বাজিতে না বাজিতেই শয্যা গ্রহণ করেন; কিন্তু আজ সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছে। পরক্ষণেই দাসীর গলা শুনা গেল। সে বলিতেছে, এখন সোয়ামী মারা গেছে—আর যে মৃণাল-দিদিমণি শ্বশুরঘর করে, এমন ত আমার মনে হয় না বাবু। জামাইবাবুর সঙ্গে কি যে দাদা-নাতনী সুবাদ, তা তেনারাই জানে।

প্রত্যুত্তরে কেদারবাবু শুধু হুঁ বলিয়াই চুপ করিয়া রহিলেন।

অচলা বুঝিল, ইতিপূর্বে অনেক কথাই হইয়া গিয়াছে। মৃণালের সম্বন্ধে, মহিমের সম্বন্ধে, তাহার সম্বন্ধে—কিছুই বাদ যায় নাই। কিন্তু পাছে নিজের সম্বন্ধে নিরতিশয় অপ্রিয় কথা নিজের কানেই শুনিতে হয়, এই ভয়ে সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল, তেমনই নীরবে ফিরিয়া যাইতে চাহিল; কিন্তু কিসে যেন তাহার পা লোহার শিকলে বাঁধিয়া দিয়া গেল।

কেদারবাবু অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, দু’জনের তা হলে বনিবনাও হয়নি বল?

ঝি কহিল, মোটে না বাবু, মোটে না। একটি দিনের তরে না।

এই দাসীটিকে অচলা নির্বোধ বলিয়াই এতদিন জানিত; আজ দেখিল, বুদ্ধি তাহার কাহারো অপেক্ষা কম নয়।

কেদারবাবু আবার মিনিট-খানেক মৌন থাকিয়া বলিলেন, কাল রাতে তা হলে কারও খাওয়া হয়নি বল? সুরেশ যাওয়া পর্যন্তই একরকম ঝগড়াঝাঁটিতেই দিন কাটছিল?

দাসীর উত্তর শুনা গেল না বটে, কিন্তু পিতার মুখের মন্তব্য শুনিয়াই বুঝা গেল, সে গ্রীবা আন্দোলনের দ্বারা কিরূপ অভিমত ব্যক্ত করিল। কারণ, পরক্ষণেই কেদারবাবু একটা গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, এমনটি যে একদিন ঘটবে, আমি আগেই জানতুম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ত বাপ-মায়ের কথা গ্রাহ্য করে না; নইলে আমি ত সমস্তই একরকম ঠিক করে এনেছিলুম। আজ তা হলে ওর ভাবনা কি! বলিয়া আর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন, তাহাও স্পষ্ট শুনিতে পাওয়া গেল।

ঝি পূর্ণ সহানুভূতির সহিত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কহিল, তাই বলুন ত বাবু, নইলে আজ ভাবনা কি! কোন্‌ অজ পাড়াগাঁয়ে কিনা একটা খোড়ো মেটে বাড়ি! তাও রইল কৈ? আজ জামাইবাবুও ত—, বলিয়া সেও কথাটাকে শেষ না করিয়াও একটা দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা অনেকদূর পর্যন্ত ঠেলিয়া দিল।

35 Shares