গৃহদাহ

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গিল, তখন বেলা হইয়াছে। তরুণ সূর্যালোক খোলা জানালার ভিতর দিয়া ঘরের মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সে ধীরে ধীরে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া শিয়রের জানালাটা খুলিয়া দিয়া বাহিরের পথের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

কলিকাতার রাজপথে জনপ্রবাহের বিরাম নাই। কেহ কাজে চলিয়াছে, কেহ ঘরে ফিরিতেছে, কেহ-বা প্রভাতের আলোক ও হাওয়ার মধ্যে শুধু শুধু ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—চাহিয়া চাহিয়া হঠাৎ এক সময়ে তাহার মনে হইল, এ সময়ে কেহই ত ঘরে বসিয়া নাই, আর আমিই বা যথার্থ কি এমন গুরুতর অপরাধ করিয়াছি, যাহাতে মুখ দেখাইতে পারি না—আপনাকে আপনি আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি! অপরাধ যদি কিছু করিয়াই থাকি ত সে তাঁর কাছে। সে দণ্ড তিনিই দিবেন; কিন্তু নির্বিচারে যে-কেহ শাস্তি দিতে আসিবে, তাহাই মাথা পাতিয়া লইব কিসের জন্য?

অচলা তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং সমস্ত গ্লানি যেন জোর করিয়া ঝাড়িয়া ফেলিয়া হাত-মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল।

কেদারবাবু তাঁহার আরাম-কেদারায় বসিয়া খবরের কাগজ পাঠ করিতেছিলেন, একটিবার মাত্র মুখ তুলিয়াই আবার সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় মনঃসংযোগ করিলেন।

খানিক পরেই বেয়ারা কেৎলিতে গরম চায়ের জল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আনিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া গেল, কেদারবাবু নিজে উঠিয়া আসিয়া নিজের জন্য এক পেয়ালা চা প্রস্তুত করিয়া লইলেন এবং বাটিটা হাতে করিয়া নিঃশব্দে তাঁহার আরাম-চৌকিতে ফিরিয়া গিয়া খবরের কাগজ লইয়া বসিলেন।

অচলা নতমুখে বসিয়া পিতার আচরণ সমস্ত লক্ষ্য করিল, কিন্তু নিজে যাচিয়া তাঁহার চা তৈরি করিয়া দিতে কিংবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে তাহার সাহসও হইল না, ইচ্ছাও করিল না।

কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন করিয়া কাঠের মূর্তির মত মুখ বুজিয়া বসিয়া থাকাও অসম্ভব। এমন কি, এইভাবে দীর্ঘকাল এক গৃহের মধ্যেও তাঁহার সহিত বাস করা সম্ভবপর এবং উচিত কিনা এবং না হইলেই বা সে কি উপায় করিবে, এই জটিল সমস্যার কোথাও একটু নিরালায় বসিয়া মীমাংসা করিয়া লইতে যখন সে উঠি-উঠি করিতেছিল, এমন সময়ে দুঃসহ বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, সুরেশ ঘরে প্রবেশ করিতেছে।

সে হাত তুলিয়া কেদারবাবুকে নমস্কার করিতে তিনি মুখ তুলিয়া মাথাটা একটু নাড়িয়া পুনশ্চ পড়ায় মন দিলেন।

সুরেশ চেয়ার টানিয়া লইয়া বসিল। চায়ের জিনিসগুলা সরাইবার জন্য বেয়ারা ঘরে ঢুকিতেই তাহাকে কহিল, আমার ব্যাগটা কোথায় আছে, আমার গাড়িতে তুলে দাও ত। শেভ করবার জিনিসগুলো পর্যন্ত তার মধ্যে আছে। দেরি করো না, আমি এখ্‌খুনি যাবো।

যে আজ্ঞে বলিয়া সে চলিয়া গেলে আবার সমস্ত কক্ষটা স্তব্ধ হইয়া রহিল। খানিক পরে সুরেশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, মহিমের কোন খবর পাওয়া গেল?

কেদারবাবু মুখ তুলিয়াই শুধু বলিলেন, না।

সুরেশ কহিল, আশ্চর্য!

তার পরে আবার সমস্ত চুপচাপ। বেহারা ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, ব্যাগ তাঁহার গাড়িতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।

আমি তা হলে চললুম। মহিমের চিঠি এলে আমাকে একটু খবর পাঠাবেন, বলিয়া সুরেশ উঠিবার উপক্রম করিতেই সহসা কেদারবাবু হাতের কাগজখানা মাটিতে ফেলিয়া দিয়া বলিয়া উঠিলেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর সুরেশ, আমি আসচি। বলিয়া তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়াই চটিজুতার পটাপট শব্দ করিয়া একটু দ্রুতবেগেই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

এতক্ষণ অবধি অচলা অধোমুখেই ছিল। তিনি বাহির হইয়া যাইতেই বিস্মিত সুরেশ অকস্মাৎ মুখ ফিরাইতেই তাহার দৃষ্টি অচলার ত্রস্তপীড়িত ও একান্ত মলিন দুই চক্ষুর উপর গিয়া পড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি?

অচলা মুখ আনত করিয়া শুধু মাথা নাড়িল।

সুরেশ বলিল, আমি যে কত দুঃখিত, কত লজ্জিত হয়েচি তা বলে জানাতে পারিনে।

অচলা অধোমুখে নীরবে বসিয়া রহিল।

সে পুনশ্চ কহিল, তোমার বাবা যে আমাকে এমন হীন, এত বড় পাষণ্ড ভাবতে পারেন, এ আমি স্বপ্নেও মনে করিনি।

এ অভিযোগেও অচলা কোন উত্তর দিল না, তেমনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

সুরেশ বলিল, আমার এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে এখ্‌খুনি মহিমের কাছে গিয়ে তাকে—কথাটা শেষ হইতে পাইল না, কেদারবাবু ফিরিয়া আসিলেন।

তাঁহার হাতে একখানা ছোট কাগজ। সেইখানা সুরেশের সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া কহিলেন, গড়িমসি করে তোমার সেই টাকাটার একখানা রসিদ দেওয়া আর ঘটে উঠেনি। পাঁচ হাজার টাকার হ্যান্ডনোট লিখেই দিলুম—সুদ বোধ হয় আর দিতে পারব না; তবে এই বাড়িটা ত রইল, এর থেকে আসলটা শোধ হতে পারবেই।

সুরেশ স্তম্ভিতের ন্যায় ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, আমি ত আপনার কাছে হ্যান্ডনোট চাইনি কেদারবাবু!

কেদারবাবু বলিলেন, তুমি চাওনি সত্য, কিন্তু আমার ত দেওয়া উচিত। এতদিন যে দিইনি, সেই আমার যথেষ্ট অন্যায় হয়ে গেছে সুরেশ, কাগজখানা তুমি পকেটে তুলে রাখো। বুড়ো হয়েচি, হঠাৎ যদি মরে যাই, টাকাটার গোল হতে পারে।

সুরেশ আবেগের সহিত জবাব দিল, কেদারবাবু, সুরেশ আর যাই করুক, সে টাকা নিয়ে কখনো কারোর সঙ্গে গোল করে না। তা ছাড়া আপনি নিজেও বেশ জানেন, এ টাকা আমি চাইনে—এ আমি আমার বন্ধুকে যৌতুক দিয়েচি।

কেদারবাবু বলিলেন, তা হলে সে তোমার বন্ধুকেই দিয়ো, আমাকে নয়। আমি যা নিয়েছি, সে আমারই ঋণ।

সুরেশ কহিল, বেশ, আমার বন্ধুকেই দেবো, বলিয়া কাগজখানা টেবিল হইতে তুলিয়া লইয়া দুই পা পিছাইয়া গিয়া অচলার সম্মুখে দাঁড়াইবামাত্রই, কেদারবাবু অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। চিৎকার করিয়া বলিলেন, খবরদার সুরেশ! কাল থেকে অনেক অপমান আমি নিঃশব্দে সহ্য করেচি, কিন্তু আমার মেয়েকে আমার চোখের সামনে তুমি টাকা দিয়ে যাবে, সে আমার কিছুতেই সইবে না বলে দিচ্ছি। বলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহার আরাম-কেদারায় ধপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন।

35 Shares