গৃহদাহ

সুরেশ এবং অচলা উভয়েই নীরবে এবং অধোমুখে বসিয়া রহিল। কেদারবাবু হঠাৎ একসময়ে দাঁড়াইয়া পড়িয়া, মেয়েকে উদ্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, না মা অচলা, এ চলবে না। কোনমতেই না। সুরেশবাবু, আপনি যেমন কর্তব্য সকলের উপরে রেখে বন্ধুর কাজ করতে এসেছেন, আমিও সেই কর্তব্যকেই সুমুখে রেখে পিতার কাজ করব। অচলার সঙ্গে মহিমের সম্বন্ধটা যতদূর অগ্রসর হয়েচে, তাতে যদি বিনা প্রমাণে আমার বাড়ির দরজা তার মুখের উপর বন্ধ করে দিই, ঠিক হবে না। সেইজন্য একটা প্রমাণ চাই। আপনি মনে করবেন না সুরেশবাবু, আপনার কথায় আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি, কিন্তু এটাও আমার কর্তব্য। কি, মা অচলা! একটা প্রমাণ নেওয়া আমাদের উচিত কি না?

উভয়েই তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল, উচিত-অনুচিত কোন মন্তব্যই কেহ প্রকাশ করিল না।

কেদারবাবু ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়াই বলিলেন, কিন্তু এ প্রমাণের ভার আপনারই উপর, সুরেশবাবু। মহিমের সাংসারিক অবস্থা জানা ত দূরের কথা, কোন্‌ গ্রামে যে তার বাড়ি তাই আমরা জানিনে।

বেহারা আসিয়া জানাইল, নীচে বিকাশবাবু অপেক্ষা করিতেছেন।

সংবাদ শুনিয়া কেদারবাবু শুষ্ক হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, আজ ত তাঁর আসবার কথা ছিল না। আচ্ছা, বল গে আমি যাচ্চি। ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, সুরেশবাবু, আমাকে মিনিট-পাঁচেক মাপ করতে হবে—লোকটাকে বিদায় করে আসি। যখন এসেছে, তখন দেখা না করে ত নড়বে না। মা অচলা, সুরেশবাবুকে আমাদের পরম বন্ধু বলে মনে করবে। যা তোমার জানবার প্রয়োজন, এঁর কাছে জেনে নাও—আমি এলাম বলে। বলিয়া তিনি নীচে নামিয়া গেলেন।

তখন মুহূর্তকালের জন্য চোখাচোখি করিয়া উভয়েই মাথা হেঁট করিল। সুরেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমরা উভয়ে আশৈশব বন্ধু। কিন্তু তার ব্যবহারে আপনাদের কাছে আমার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে।

অচলা মৃদুকণ্ঠে কহিল, তার জন্যে আপনার কোন লজ্জার কারণ নেই।

সুরেশ কহিল, আপনি বলেন কি! তার এই কপট আচরণে, এই পাষণ্ডের মত ব্যাবহারে আমি বন্ধু হয়ে যদি লজ্জা না পাই ত আর কে পাবে বলুন দেখি? কিন্তু তখনই ত আমার বোঝা উচিত ছিল যে, সে যখনই আমাকেই আগাগোড়া গোপন করে গেছে, তখন ভিতরে কোথাও একটা বড় রকমের গলদ আছেই।

অচলা কহিল, আমরা ব্রাহ্ম-সমাজের। কিন্তু আপনি এ-সমাজের কোন লোকের কোন সংস্রবে থাকতে চান না বলেই বোধ করি তিনি আমাদের উল্লেখ আপনার কাছে করেন নি।

কথাটা সুরেশের ভাল লাগিল না। অচলা যে তাহারই মুখের উপর মহিমের দোষক্ষালনের চেষ্টা করিবে, ইহা সে ভাবে নাই। শুষ্কস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, এ খবর আপনি মহিমের কাছে শুনেচেন আশা করি।

অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, হাঁ, তিনিই একদিন বলেছিলেন।

সুরেশ বলিল, আমার দোষের কথা সে বলতে ভোলেনি দেখচি।

অচলা ম্লানভাবে একটুখানি হাসিয়া কহিল, এ আর দোষের কথা কি? সকল মানুষের প্রবৃত্তি একরকমের নয়। যারা আপনাদের সংস্রব ছেড়ে চলে গেছে, তাদের যদি আপনাদের ভাল না লাগে ত আমি দোষের মনে করতে পারিনে।

এই উত্তরটা যদিচ সুরেশের মনের মত, এবং আর কোথাও শুনিলে হয়ত সে লাফাইয়া উঠিত, কিন্তু এই সংযতবাদিনী তরুণী ব্রাহ্মমহিলার মুখ হইতে ব্রাহ্ম-সমাজের প্রতি তাহার একান্ত বিতৃষ্ণার কথা শুনিয়া আজ তাহার কিছুমাত্র আনন্দোদয় হইল না। বস্তুতঃ, এই-সব দলাদলির মীমাংসা শুনিতে সে কথাটা বলেও নাই। বরঞ্চ প্রত্যুত্তরে নিজের সম্বন্ধে ইহাও জানিতে চাহিয়াছিল, মহিমের মুখ হইতে তাহার আর কোন সদ্‌গুণের বিবরণ তাঁহার কানে গিয়াছে কিনা অচলা বোধ করি এই প্রচ্ছন্ন অভিলাষ অনুমান করিতে পারিল না। তাই প্রশ্নটার সোজা জবাব দিয়াই চুপ করিয়া রহিল।

সুরেশ ক্ষুণ্ণ হইয় কহিল, আপনাদের প্রতি আমার সামাজিক বিদ্বেষ আছে কি না, সে আলোচনা মহিম করুক; কিন্তু তার ওপর আমার যে লেশমাত্র বিদ্বেষ নেই, এ কথাটা আপনি আমার মুখ থেকেও অবিশ্বাস করবেন না। তবুও হয়ত আমি তার সাংসারিক প্রসঙ্গ এখানে তুলতে আসতাম না—যদি না সে আমার কাছে সেদিন সত্য কথাটা অস্বীকার করত।

অচলা সুরেশের মুখের উপর স্থির দৃষ্টি রাখিয়া অবিচলিত-স্বরে কহিল, কিন্তু তিনি ত কখনই মিথ্যা বলেন না।

এইবার সুরেশ বাস্তবিকই বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। মেয়েমানুষের মুখ দিয়া যে এমন শান্ত অথচ দৃঢ় প্রতিবাদ বাহির হইতে পারে, ক্ষণকাল ইহা যেন ভাবিয়াই পাইল না। কিন্তু সে ঐ মুহূর্তকালের জন্য। জীবনে সে সংযম শিক্ষা করে নাই, তাই পরক্ষণেই আত্মবিস্মৃত হইয়া রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, আমাকে মাপ করবেন, কিন্তু সে আমার বাল্যবন্ধু। আপনার চেয়ে তাকে আমি কম জানিনে। এখানে নিজেকে আবদ্ধ করে স্পষ্ট অস্বীকার করাটাকে আমি সত্যবাদিতা বলতে পারিনে।

অচলা তেমনি শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলিল, তিনি ত এখানে নিজেকে আবদ্ধ করেন নি।

সুরেশ কহিল, আপনার বাবা ত তাই বললেন। তা ছাড়া নিজের হীন অবস্থা আপনাদের কাছে গোপন করাটাকেও ঠিক সত্যপ্রিয়তা বলা চলে না। স্ত্রী-পুত্র প্রতিপালন করবার অক্ষমতা অপরের কাছে না হোক, অতঃপর আপনার কাছেও ত তার অকপটে প্রকাশ করা উচিত ছিল।

অচলা নীরব হইয়া রহিল।

সুরেশ বলিতে লাগিল, আপনি যে এত করে তার দোষ ঢাকচেন, আপনিই বলুন দেখি, সমস্ত কথা পূর্বাহ্ণে জানতে পারলে কি তাকে এতটা প্রশ্রয় দিতে পারতেন?

অচলা তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল। তাহার কাছে কোনপ্রকার জবাব না পাইয়া সুরেশ অধিকতর উত্তেজিত হইয়া কহিতে লাগিল, আমার কাছে সে নিজের মুখে স্বীকার করেছে যে, এই কলকাতা শহরে আপনাকে প্রতিপালন করবার তার সাধ্যও নেই, সঙ্কল্পও নেই। তার সেই ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ গ্রামে একটা অত্যন্ত বিরুদ্ধ হিন্দুসমাজের মধ্যে সে যে আপনাকে একখানা অসচ্ছল ভাঙ্গা মেটে-বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে চায়, সে কথা কি আপনাকে তার বলা কর্তব্য নয়? এত দুঃখ আপনি সহ্য করতে প্রস্তুত কিনা, এও কি জিজ্ঞাসা করা সে আবশ্যক বিবেচনা করে না? বলিয়া উত্তরের জন্য চোখ তুলিয়া দেখিল, অচলা চিন্তিত, অধোমুখে স্থির হইয়া বসিয়া আছে। জবাব না পাইলেও সুরেশ বুঝিল, তাহার কথায় কাজ হইয়াছে। কহিল, দেখুন, আপনার কাছে এখন আমি সত্য কথাই বলব। আজ আমি আমার বন্ধুকে বাঁচাবার সঙ্কল্প করেই শুধু এসেছিলুম—সে বিপদে না পড়ে, এই ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন দেখছি, তাকে বাঁচানোর চেয়ে আপনাকে বাঁচানো আমার ঢের বেশি কর্তব্য। কারণ, তার বিপদ ইচ্ছাকৃত, কিন্তু আপনি ঝাঁপ দিচ্চেন অন্ধকারে। এইমাত্র আপনার বাবা যখন আমাকেই প্রমাণ করবার ভার দিলেন, তখন মনে হয়েছিল, বন্ধুর বিরুদ্ধে এ ভার আমি গ্রহণ করব না; কিন্তু এখন দেখচি, এ কাজ আমাকে করতেই হবে—না করলে অন্যায় হবে।

35 Shares