গৃহদাহ

মৃণাল তাড়াতাড়ি হেঁট হইয়া সুরেশের পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া কহিল, আচ্ছা থাক।

সুরেশ বিস্ময়ে অবাক হইয়া কহিল, এটা আবার কি হলো মৃণাল?

কোন্‌টা নদা?

কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ পায়ের ধূলো নেওয়াটা?

মৃণাল কহিল, বড়ভাইয়ের ধূলো নিতে কি আবার দিনক্ষণ দেখাতে হয় নাকি? বলিয়া হাসিয়া উঠিয়া গেল।

আচ্ছা মেয়ে ত! বলিয়া সস্নেহে-হাস্যে সুরেশ অচলার প্রতি চাহিতে গিয়া বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হইয়া গেল। তাহার সমস্ত মুখ শ্রাবণ-আকাশের মত ঘন মেঘে যেন আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে, এমনি বোধ হইল। কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাইয়া এ-সম্বন্ধে কোনোপ্রকার প্রশ্নের আভাসমাত্র দিবার পূর্বেই অচলা হতবুদ্ধি সুরেশকে আকাশ-পাতাল ভাবিবার অজস্র অবকাশ দিয়া ত্বরিতপদে মৃণালের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল।

সেইখানে স্তব্ধভাবে বসিয়া সুরেশ কেবলি আপনাকে আপনি জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, এ কিসে কি হইল? মৃণালের প্রণাম করার সঙ্গে ইহার কেমন করিয়া যেন একটা নিগূঢ় যোগ আছে, তাহা সে নিজের ভিতর হইতেই নিশ্চয় অনুমান করিতে লাগিল; কিন্তু এ যোগ কোথায়? কেন মৃণাল অকস্মাৎ তাহার পদধূলি মাথায় লইয়া চলিয়া গেল, এবং পলক না ফেলিতে কেনই-বা অচলা ওরূপ বিবর্ণমুখে ঘর ছাড়িয়া প্রস্থান করিল। নিজের ব্যবহার ও কথাবার্তাগুলা সে আগাগোড়া বারংবার তন্ন তন্ন করিয়া স্মরণ করিয়াও কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজিয়া পাইল না। অথচ পাশাপাশি এত বড় দুটা ঘটনাও কিছু শুধু শুধু ঘটে নাই, তাহাও সে বুঝিল। সুতরাং তাহারই কোন অজ্ঞাত নিন্দিত আচরণই যে এই অনর্থের মূল, এ সংশয় তাহার মনের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধিতে লাগিল।

কিন্তু মৃণালকেও এ-সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রশ্ন করা অসম্ভব। রাত্রিটা সে এক-রকম পাশ কাটাইয়া রহিল, এবং প্রভাতে একসময়ে অচলাকে নিভৃতে পাইয়া কহিল, তোমাকে একটা কথার জবাব দিতে হবে।

অচলার মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। প্রশ্নটা যে কি, সে তাহার অগোচর ছিল না। গত রাত্রির সেই তাহার অদ্ভুত আচরণের এই কৈফিয়ত দিতে হইবে বুঝিয়া সে আরক্ত-মুখে মৃদুকণ্ঠে কহিল, কি কথা?

সুরেশ আস্তে আস্তে বলিল, কাল মৃণাল হঠাৎ আমার পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে গেল, তুমিও মুখ ভার করে রাগ করে চলে গেলে, সে কি তার শাশুড়ির মরণের কথা বলেছিলুম বলে?

এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে অচলা একটা পথ দেখিতে পাইয়া মনে মনে খুশি হইয়া বলিল, এ-রকম প্রসঙ্গ কি তোমার তোলা উচিত ছিল? সে বেচারার স্বামী নেই, শাশুড়ির মৃত্যুতে তার নিঃসহায় অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ দিকি!

সুরেশ অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, আমার ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি যে আর বেশীদিন বাঁচতে পারেন না, এ ত মৃণাল নিজেও বোঝে। তা ছাড়া সে নিঃসহায় হবেই বা কেন?

অচলা জবাব দিল, এ কথা আমরা ত তাকে একবারও বলিনি। বরঞ্চ তুমিই তাকে নানারকমে ভয় দেখালে, দেশে সে একলাটি থাকবে কেমন করে?

সুরেশ অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে সে যাবার পূর্বে আমার কি তাকে সাহস দেওয়া উচিত নয়? তার যে কোন ভয় নেই, এ কথা কি তাকে—বলিতে বলিতেই অকৃত্রিম করুণায় তাহার কণ্ঠ সজল হইয়া আসিল।

অচলা তাহার মুখের পানে চাহিয়া হাসিল। এই পরদুঃখকাতর সহৃদয় যুবকের সহস্র দয়ার কাহিনী তাহার চক্ষের নিমিষে মনে পড়িয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তোমার সাহস দিতেও হবে না, ভয় দেখিয়েও কাজ নেই। যখন সে সময় আসবে, তখন আমি চুপ করে থাকব না।

সুরেশ আত্মবিস্মৃত আবেগভরে অকস্মাৎ তাহার হাতখানা সজোরে চাপিয়া ধরিয়া প্রচণ্ড একটা নাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, এই ত তোমার যোগ্য কথা! এই ত তোমার কাছে আমি চাই অচলা! বলিয়া ফেলিয়াই কিন্তু অপরিসীম লজ্জায় হাত ছাড়িয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।

তাহার যে উচ্ছ্বাস মুহূর্তপূর্বে পরার্থপরতার নির্মল আনন্দের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াছিল, এই লজ্জিত পলায়নে তাহা এক নিমিষেই কদর্য কলুষিত হইয়া দেখা দিল। অচলার বুকের রক্ত বিদ্যুৎবেগে প্রবাহিত হইয়া বিন্দু বিন্দু ঘামে ললাট ভরিয়া উঠিল এবং সর্বাঙ্গ বারংবার শিহরিয়া উঠিয়া নিকটবর্তী একখানা চেয়ারের উপর সে নির্জীবের মত বসিয়া পড়িল। কিছুক্ষণে তাহার সে ভাবটা কাটিয়া গেল বটে, কিন্তু পীড়িত স্বামীর শয্যায় গিয়া নিজের আসনটি গ্রহণ করিতে আজ সমস্ত সকালটা তাহার কেমন যেন ভয় ভয় করিতে লাগিল।

যাই যাই করিয়াও যাইতে মৃণালের দিন-দুই দেরি হইয়া গেল। মহিমের কাছে বিদায় লইতে গিয়া দেখিল, আজ সে পাশ ফিরিয়া অত্যন্ত অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যে বিদায় লইতে আসিয়াছিল, সে এই মিথ্যা নিদ্রার হেতু নিশ্চিত অনুমান করিয়াও চুপি চুপি কহিল, ওঁকে আর জাগিয়ে কাজ নেই সেজদি। কি বল?

প্রত্যুত্তরে অচলার ঠোঁটের কোণে শুধু একটুখানি বাঁকা হাসি দেখা দিল। মৃণাল মনে মনে বুঝিল, এ ছলনা সে ছাড়াও আরো একটি নারীর কাছে প্রকাশ পাইয়াছে। তাহার বিরুদ্ধে অচলা অন্তরের মধ্যে যে গোপন ঈর্ষার ভাব পোষণ করে, তাহা সে মহিমের কাছে কোনদিন আভাসমাত্র না পাইয়াও জানিত। এই একান্ত অমূলক দ্বেষ তাহাকে কাঁটার মত বিঁধিত। কিন্তু তথাপি অচলা যে নিজের হীনতা দিয়া আজিকার দিনেও ওই পীড়িত লোকটির পবিত্র দুর্বলতাটুকুকে বিকৃত করিয়া দেখিবে, তাহা সে ভাবে নাই। মুহূর্তকালের নিমিত্ত তাহার মনটা জ্বালা করিয়া উঠিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া কানে কানে কহিল, তুমি ত সব জান সেজদি, আমার হয়ে ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো। বলো, ভাল হয়ে আবার যখন দেশে ফিরবেন, বেঁচে থাকি ত দেখা হবে।

নীচে কেদারবাবু বসিয়াছিলেন। মৃণাল প্রণাম করিয়া দাঁড়াইতেই তাঁহার চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল। এই অল্পকালের মধ্যেই সকলের মত তিনিও এই বিধবা মেয়েটিকে অতিশয় ভালবাসিয়াছিলেন। জামার হাতায় অশ্রু মুছিয়া কহিলেন, মা, তোমার কল্যাণেই মহিমকে আমরা যমের মুখ থেকে ফিরে পেয়েছি। যখনি ইচ্ছে হবে, যখনই একটু বেড়াবার সাধ হবে, তোমার এই বুড়ো ছেলেটিকে ভুলো না মা। আমার বাড়ি তোমার জন্যে রাত্রি-দিন খোলা থাকবে মৃণাল।

35 Shares