গৃহদাহ

অচলা অদূরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। মৃণাল তাহাকে দেখাইয়া হাসিমুখে কহিল, যমের বাপের সাধ্যি কি বাবা, ওঁর কাছ থেকে সেজদাকে নিয়ে যায়! যেদিন সেজদির হাতে পৌঁছে দিয়েছি, সেইদিনই আমার কাজ চুকে গেছে।

কেদারবাবুর মুখের ভাব একটু গম্ভীর হইল, কিন্তু আর তিনি কিছু বলিলেন না।

দুইজন বৃদ্ধগোছের কর্মচারী ও একজন দাসী মৃণালকে দেশে পৌঁছাইয়া দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল; তাহাদের সকলকে লইয়া স্টেশনের অভিমুখে ঘোড়ার গাড়ি ফটকের বাহির হইয়া গেলে কেদারবাবুর অন্তরের ভিতর হইতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। ধীরে ধীরে শুধু বলিলেন, অদ্ভুত, অপূর্ব মেয়ে!

সুরেশের মনটাও বোধ করি এইভাবে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। সে কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া সায় দিয়া আবেগের সহিত বলিয়া উঠিল, আমি কখনো এমনটি আর দেখিনি কেদারবাবু! এমন মিষ্টি কথাও কখনো শুনিনি, এমন নিপুণ কাজকর্মও কখনো দেখিনি। যে কাজ দাও, এমন অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে করে দেবে যে মনে হবে যেন এই নিয়েই সে চিরকালটা আছে। অথচ আশ্চর্য এই যে, কোনদিন গ্রামের বাইরে পর্যন্ত যায়নি।

কেদারবাবু ইহা সত্য বলিয়া জানিলেও বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, বল কি সুরেশ!

সুরেশ কহিল, যথার্থই তাই। ওর পানে চেয়ে চেয়ে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, এই যে জন্মান্তরের সংস্কার বলে একটা প্রবাদ আছে, কি জানি সত্যি নাকি! বলিয়া হাসিতে লাগিল।

পরকাল-সম্বন্ধীয় প্রসঙ্গে কেদারবাবু চিন্তাযুক্ত মুখে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন, তা সে যাই হোক, এ কয়দিন দেখে দেখে আমার নিশ্চয় বিশ্বাস হয়েছে, এ মেয়ে স্ত্রীলোকের মধ্যে অমূল্য রত্ন। একে সারাজীবন এমন জীবন্মৃত করে রাখা শুধু পাপ নয়, মহাপাপ। ও আমার মেয়ে হলে আমি কোনমতেই নিশ্চেষ্ট থাকতে পারতুম না।

সুরেশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি করতেন?

বৃদ্ধ উদ্দীপ্তস্বরে বলিলেন, আমি আবার বিবাহ দিতুম। একটা বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ওর ওই উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে যারা ওকে সন্ন্যাসিনী সাজিয়েছে, তারা ওর মিত্র নয়, ওর শত্রু। শত্রুর কার্যকে আমি কোনমতেই ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করে নিতুম না।

একটু মৌন থাকিয়া পুনরায় কহিতে লাগিলেন, তাছাড়া ওর স্বামীর ব্যবহারটাই একবার মনে করে দেখ দিকি সুরেশ। সে লোকটার দু-দুটো স্ত্রী গত হতে পঞ্চাশ বছর বয়সে যখন এমন মেয়েকে বিবাহ করতে রাজি হলো তখন নিজের সুখ-সুবিধে ভিন্ন স্ত্রীর ভবিষ্যতের দিকে পাষণ্ড কতটুকু দৃষ্টিপাত করেছিল, কল্পনা কর দেখি।

সুরেশকে নিরুত্তর দেখিয়া বৃদ্ধ অধিকতর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, না সুরেশ, আমি বিধবা-বিবাহের ভালমন্দ তর্ক তুলচি নে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোমার সমস্ত হিন্দুসমাজ চিৎকার করে ম’লেও আমি মানবো না, এই ব্যবস্থাই ওই দুধের মেয়েটার পক্ষে চরম শ্রেয়ঃ। ওর এমন এতটুকু কিছু নেই, যার মুখ চেয়ে ও একটা দিন কাটাতে পারে। সমস্ত জীবনটা কি তোমরা খেলার জিনিস পেয়েছ সুরেশ, যে ব্রহ্মচর্য ব্রহ্মচর্য করে চেঁচালেই সারা দুনিয়াটা ওর জন্যেই রাতারাতি বদলে ঋষির তপোবন হয়ে উঠবে! মেয়েটার শুধু কাপড়-চোপড়ের পানে চাইলে আমার বুক যেন ফেটে যেতে থাকে।

সুরেশ জবাব দিল না, মুখ তুলিয়াও চাহিল না; কিন্তু চোখের কোণে দেখিতে পাইল যে, চৌকাঠে ভর দিয়া অচলা এতক্ষণ পর্যন্ত মূর্তির মত দাঁড়াইয়াছিল—সেখানে আর সে নাই, কখন নিঃশব্দে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেছে।

মৃণাল চলিয়া গেলে, অচলা যখনই সুরেশের মুখের দিকেই দিকে চাহিয়া দেখে, তখনই তাহার মনে হয়, সে বিমনা হইয়া আছে এবং কিসের শোক যেন তাহাকে নিরন্তর শুষ্ক করিয়া ফেলিতেছে।

দুই দিন পরে একদিন অপরাহ্ণে সুরেশ নীচের বারান্দার একধারে রৌদ্রের মধ্যে আরাম-কেদারাটা টানিয়া লইয়া কি একখানা বই পড়িতেছিল, পদশব্দে চাহিয়া দেখিল, তাহারই জন্য চা লইয়া অচলা নিজে আসিতেছে। এরূপ ঘটনা পূর্বে কোনদিন ঘটে নাই; তাই সে আশ্চর্য হইয়া সোজা উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেয়ারা কৈ? আজ তুমি যে!

অচলা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়াই একটা ছোট টিপয় চেয়ারের পাশে টানিয়া চায়ের বাটি নামাইয়া রাখিল এবং আর একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া নিজেও বসিয়া পড়িল।

এই অভিনব আচরণে তাহাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে আর সুরেশের সাহস হইল না। শুধু চায়ের পেয়ালাটা নীরবে হাতে তুলিয়া লইল।

কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া অচলা মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, সুরেশবাবু, আপনি কি বিধবা-বিবাহ কোন ক্ষেত্রেই ভাল বলে মনে করেন না?

সুরেশ চায়ের বাটি হইতে মুখ না তুলিয়াই জবাব দিল, করি। তার কারণ, কুসংস্কার আজও আমার অতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় নি।

অচলা চিন্তা করিবার নিজেকে আর মুহূর্ত অবসর না দিয়া বলিল, তাহলে মৃণালের মত মেয়েকে বিবাহ করতে আপনার ত লেশমাত্র আপত্তি থাকা উচিত নয়।

সুরেশ চায়ের বাটিটা হাতে করিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া বলিল, এ কথার মানে?

অচলার মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনরূপ উত্তেজনা প্রকাশ পাইল না। বেশ সহজভাবে বলিল, আপনার কাছে আমি অসংখ্য ঋণে ঋণী। তা ছাড়া আমি আপনার হিতাকাঙিক্ষণী। আপনাকে আমি সুষ্ঠু, সহজ, সংসারী এবং স্বাভাবিক দেখতে চাই। একদিন আপনি বিবাহ করতে প্রস্তুত ছিলেন, আজ আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি স্বীকার করুন।

এক নিশ্বাসে মুখস্থর মত এতগুলা কথা বলিয়া অচলা যেন হাঁপাইতে লাগিল।

সুরেশ পাথরে-গড়া মূর্তির মত অনেকক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে কহিল, এতে তুমি কি সত্যই সুখী হবে?

অচলা কহিল, হাঁ।

সে রাজি হবে?

তাই ত আমার বিশ্বাস।

সুরেশ একটুখানি ম্লান হাসিয়া বলিল, আমার বিশ্বাস তা নয়। বইয়ে পড়েছ ত সহমরণের দিনে কোন কোন সতী হাসতে হাসতে পুড়ে মরত। মৃণাল তাদেরই জাত। এদের মুখের কথায় সম্মত করানো ত ঢের দূরের কথা, একটা একটা করে হাত-পা কাটতে থাকেলেও একে আর একবার বিয়ে করতে রাজী করানো যাবে না। এ অসাধ্য-সাধনের চেষ্টা করে মাঝ থেকে আমাকে তার কাছে মাটি করে দিও না অচলা। আমাকে সে দাদা বলে ডেকেছে, তার কাছে আমি সম্মানটুকু বজায় রাখতে চাই।

35 Shares