গৃহদাহ

দেখিতে দেখিতে অচলার সমস্ত মুখ ক্রোধে কালো হইয়া উঠিল। সুরেশের কথা শেষ হইতেই কঠিন মৃদুকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, সংসারে শুধু মৃণালই একমাত্র সতী নয় সুরেশবাবু এমন সতীও আছে, যারা মনে মনেও একবার কাউকে স্বামিত্বে বরণ করলে, সহস্র কোটি প্রলোভনেও আর তাদের নড়ানো যায় না। এদের কথা আপনি ছাপার বইয়ে পড়তে না পেলেও সত্যি বলে জেনে রাখবেন সুরেশবাবু! বলিয়া স্তম্ভিত অভিভূত সুরেশের প্রতি দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়াই এ গর্বিতা রমণী দৃঢ়-পদক্ষেপে ঘর ছাড়িয়া বাহিরে গেল।

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

একজনের উচ্ছ্বসিত অকপট প্রশংসার মধ্যে যে আর একজনের কত বড় সুকঠোর আঘাত ও অপমান লুকাইয়া থাকিতে পারে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়ের কেহই বোধ করি তাহা মুহূর্তকাল পূর্বেও জানিত না। সুরেশ হাতের বাটি হাতে লইয়া আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল, এবং অচলা তাহার ঘরে ঢুকিয়া নিঃশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বালিশে মুখ গুঁজিয়া মর্মান্তিক ক্রন্দনের দুর্নিবার বেগ রোধ করিতে লাগিল,—পাশেই মহিমের ঘর, পাছে বিন্দুমাত্র শব্দও তাহার কানে গিয়া পৌঁছে। বস্তুতঃ অন্তর্যামী ভিন্ন সে কান্নার ইতিহাস আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জানিল না।

কিন্তু সে নিজে এই গভীর দুঃখের মধ্যে এক নূতন তত্ত্ব লাভ করিল। এই নারী-জীবনের সতীত্ব যে কতবড় সম্পদ, এতদিন পরে তাহার পরিপূর্ণ মহিমা আজই প্রথম যেন তাহার চোখের সম্মুখে সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত হইয়া দেখা দিল। সেদিন সুরেশের সংস্পর্শে পিতার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিকে সে অন্যায় উপদ্রব মনে করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ ও ব্যথিত হইয়াছিল, কিন্তু আজ অকস্মাৎ সেই ধর্মহীন পরস্ত্রীলুব্ধ সুরেশকেই যখন সতীত্বের পাদপদ্মে অমন করিয়া মাথা পাতিয়া প্রণাম করিতে দেখিল, তখন নিজের সত্যকার স্থানটাও আর তাহার দৃষ্টির অগোচর রহিল না।

আরও একটা জিনিস। সুস্পষ্ট বাক্যের শক্তি যে কত বৃহৎ, আজ এ সত্যও সে প্রথম উপলব্ধি করিল। সে শিক্ষিতা রমণী। স্বামীর প্রতি কায়মন-নিষ্ঠাই যে সতীত্ব, এ কথা তাহার অবিদিত ছিল না। শুধু দেহ বা শুধু মন কোনটাই যে একাকী সম্পূর্ণ নয়, ইহা সে ভাল করিয়াই জানিত। তথাপি মন যখন তাহার বিচলিত হইয়াছে, স্বামীকে ভালবাসে না, জিহ্বা যখন এ কথা উচ্চরবে ঘোষণা করিতেও সঙ্কোচ মানে নাই, তখনও কিন্তু কোনদিন তাহার আপনাকে ছোট বলিয়া মনে হয় নাই। কিন্তু আজ যখন সুরেশের মুখের সুস্পষ্ট বাণী না জানিয়া তাহার নামের সঙ্গে অসতী শব্দটা যোগ করিয়া দিতে চাহিল, তখনই তাহার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন এক বুক-ফাটা বেদনার আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

তাই বলিয়া মৃণালের প্রতি যে তাহার শ্রদ্ধা বাড়িল, তাহা নহে; কিন্তু এই মেয়েটির প্রসঙ্গে যে চৈতন্য আজ লাভ করিল, ইহা সে জীবনে কখনও বিস্মৃত হইবে না, ইহা আপনার কাছে আপনি বার বার প্রতিজ্ঞা করিতে লাগিল।

বাহিরে পিতার লাঠির আওয়াজ এবং পিছনে সুরেশের পদশব্দ শুনিতে পাইল। বুঝিল, তাঁহারা মহিমকে দেখিতে চলিয়াছেন, এবং অল্পকাল পরেই পিতার কণ্ঠস্বরে তাহার আহ্বান শুনিয়া সে বেশ করিয়া আঁচলে চোখ-মুখ মুছিয়া দ্বার খুলিয়া ও-ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল।

কেদারবাবু তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, আজ ব্যাপার কি? দুটোর সময় সুরুয়া দেবার কথা, চারটে বাজে যে! ও কি, চোখ-মুখ অমন ভারী কেন? ঘুমুচ্ছিলে না কি?

অচলা উত্তর না দিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। রোগীকে সুরুয়া দিবার ব্যবস্থা হইবার পরে এই কাজটা মৃণালই করিত। চাকর চড়াইয়া দিত, সে আন্দাজ করিয়া যথাসময়ে নামাইয়া লইত। সে চলিয়া গেলে এ ভারটা অচলার উপরেই পড়িয়াছিল। আজ সে কথা তাহার মনেই ছিল না। ছুটিয়া গিয়া দেখিল, আগুন বহুক্ষণ নিবিয়া গিয়াছে এবং সমস্তটা শুকাইয়া পুড়িয়া রহিয়াছে।

বহুক্ষণ সেইখানে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন কেদারবাবু এ কথা শুনিয়া অচলাকে কিছুই না বলিয়া শুধু সুরেশকে লক্ষ্য করিয়া কঠিনভাবে বলিলেন, তখনি ত তোমাকে বলেছিলুম সুরেশ, এখন একজন ভাল নার্স না রাখলে মহিমকে বাঁচাতে পারবে না। নিজের মেয়েকে কি আমার চেয়ে তোমরা বেশি বোঝো?

সুরেশ নিরুত্তরে বসিয়া রহিল। কিন্তু মহিম যে এতক্ষণ নিঃশব্দে স্ত্রীর লজ্জিত ম্লান মুখখানির প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া ছিল, তাহা কেহই দেখে নাই। সে এখন ধীরে ধীরে কহিল, নার্সের হাতে আমার ওষুধ পর্যন্ত খেতে প্রবৃত্তি হবে না সুরেশ। তবে ওঁকে সাহায্য করবার একজন লোক দাও। কাল-পরশু দুটো রাত্রিই ওঁকে সারারাত্রি জাগতে হয়েছে। দিনের বেলায় একটু বিশ্রামের অবকাশ না পেলে কলের মানুষকে দিয়েও কাজ পাবে না ভাই।

কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য না হইলেও মিথ্যা নয়। সুরেশ খুশী হইয়া মুখ তুলিল, কিন্তু কেদারবাবু নিজের রূঢ়বাক্যে লজ্জা পাইয়া কোন-কিছু একটা বলিবার উদ্যোগ করিতেই অচলা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

রাত্রে তাহার অনেকবার ইচ্ছা করিতে লাগিল, রুগ্ন স্বামীর কাছে বহু অপরাধের জন্য কাঁদিয়া ক্ষমা ভিক্ষা চাহিয়া একবার জিজ্ঞাসা করে, তাহার মত পাপিষ্ঠাকে তিরস্কার হইতে বাঁচাইবার জন্য তাঁহার কি মাথাব্যথা পড়িয়াছিল! কিন্তু নিদারুণ লজ্জায় কোনমতেই এ প্রশ্ন তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না।

সুরেশের একটা কাজ ছিল, প্রতিদিন অনেক রাত্রে সে একবার করিয়া মহিমের ঘরে ঢুকিয়া প্রয়োজনীয় সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিয়া তবে শুইতে যাইত। মৃণাল থাকিতে সে প্রায় সারারাত্রিই আনাগোনা করিত, এবং তাহার আবশ্যকও ছিল; কিন্তু কয়দিন হইতে দেখা গেল, সে সহজে আর ঘরে প্রবেশ করে না। প্রয়োজন হইলে দাসী পাঠাইয়া খবর লয়, শুধু সন্ধ্যার প্রাক্কালে ক্ষণকালের জন্য একটিবার মাত্র নিজে আসিয়া সংবাদ গ্রহণ করে। তাহার এই নূতন আচরণ সকলের অগ্রে অচলারই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল; কিন্তু এ বিষয়ে সামান্য একটু মন্তব্য প্রকাশ করাও তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে, তাই সে মৌন হইয়াই ছিল; কিন্তু যেদিন মহিম নিজে ইহার উল্লেখ করিল, তখন তাহাকে বলিতেই হইল, আজকাল তিনি অধিকাংশ সময় বাটীতেও থাকেন না এবং ইহার হেতু কি, তাহাও সে জানে না। মহিম চুপ করিয়া শুনিল, কোনপ্রকার মতামত প্রকাশ করিল না।

35 Shares