গৃহদাহ

তুমি কিছু ভেবো না বাবা, সে আমি সমস্ত ঠিক করে নেবো, বলিয়া অচলা পুনরায় তাহার কাজের মধ্যে মনোনিবেশ করিল এবং পরদিনই লুকাইয়া তাহার দুখানা গহনা বিক্রি করিয়া নগদ টাকা সংগ্রহ করিয়া রাখিল।

ফাল্গুনের মাঝামাঝি যাত্রার সঙ্কল্প ছিল, কিন্তু সুরেশের পিসিমা পুরোহিত ডাকাইয়া পাঁজি দেখাইয়া মাসের প্রথম সপ্তাহেই দিন স্থির করিয়া দিলেন। সেই মতই সকলকে মানিয়া লইতে হইল।

যাইবার দিন-দুই পূর্ব হইতেই অচলার সারা প্রাণটা যেন হাওয়ায় ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিল। এই কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কিছুদিনের নিমিত্ত স্বামিগৃহবাস ব্যতীত তাহাকে জীবনে কখনো অন্যত্র যাইতে হয় নাই, আজিও সে পশ্চিমের মুখ দেখে নাই। সেখানে কত প্রাচীন কীর্তি, কত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, কত নদ-নদী, জলপ্রপাত, এমন কত কি আছে, যাহার গল্প লোকের মুখে শুনা ভিন্ন নিজে দেখিবার কল্পনা কোনদিন তাহার মনে স্থান পায় নাই। এইবার সেই-সকল আশ্চর্য সে স্বচক্ষে দেখিতে চলিয়াছে। তাহা ছাড়া সেখানে তাহার স্বামী ভগ্নদেহ ফিরিয়া পাইবে, একাকী সে-ই সেখানে ঘরণী, গৃহিণী, সর্বকার্যে স্বামীর সাহায্যকারিণী। সেখানে জলবায়ু স্বাস্থ্যকর, সেখানে জীবন-যাত্রার পথ সহজ ও সুগম, তিনি ভাল হইলে হয়ত একদিন তাহারা সেইখানেই তাহাদের ঘর-সংসার পাতিয়া বসিবে এবং অচিরভবিষ্যতে যে-সকল অপরিচিত অতিথিরা একে একে আসিয়া তাহাদের গৃহস্থালী পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবে, তাহাদের কচি মুখগুলি নিতান্ত পরিচিতের মতই সে যেন চোখের উপর স্পষ্ট দেখিতে লাগিল।

এমনি কত কি যে সুখের স্বপ্ন দিবানিশি তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, তার ইয়ত্তা নাই। আর সকল কথার মধ্যে স্বামী যে তাহাকে ছাড়িয়া আর স্বর্গে যাইতেও ভরসা করেন না, এই কথাটা মিশিয়া যেন তাহার সমস্ত চিন্তাকেই একেবারে মধুময় করিয়া তুলিল। আর তাহার কাহারও বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ, কোন নালিশ রহিল না—অন্তরের সমস্ত গ্লানি ধুইয়া মুছিয়া গিয়া হৃদয় গঙ্গাজলের মত নির্মল ও পবিত্র হইয়া উঠিল। আজ তাহার বড় সাধ হইতে লাগিল, যাইবার আগে একবার মৃণালকে দেখে এবং সমস্ত বুক দিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া জানা-অজানা সকল অপরাধের ক্ষমা-ভিক্ষা মাগিয়া লয়। আর সুরেশের জন্যও তাহার প্রাণ কাঁদিতে লাগিল। সে যে পরম বন্ধু হইয়াও লজ্জায় সঙ্কোচে তাহাদের দেখা দিতে পারে না, তাহার এই দুর্ভাগ্যের গোপন বেদনাটি সে আজ যেমন অনুভব করিল, এমন বোধ করি কোনদিন করে নাই। তাঁহারও কাছে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা চাহিয়া বিদায় লইবার আছে। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া জানিল, তিনি কাল হইতেই গৃহে নাই।

যাইবার দিন সকাল হইতেই আকাশে মেঘ করিয়া টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িত আরম্ভ করিয়াছিল। জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদা হইয়াছে, কিছু কিছু স্টেশনেও পাঠানো হইয়াছে, টিকিট পর্যন্ত কেনা হইয়া গিয়াছে। অচলার জন্যও সেকেন্ড ক্লাস টিকিট কেনার প্রস্তাব হইয়াছিল, কিন্তু সে ঘোরতর আপত্তি তুলিয়া মহিমকে বলিয়াছিল, টাকা মিথ্যে নষ্ট করবার সাধ থাকে ত কিনতে দাও গে। আমি সুস্থ সবল, তা ছাড়া কত বড়লোকের মেয়েরা ইন্‌টার ক্লাসের মেয়েগাড়িতে যাচ্ছে, আর আমি পারিনে? আমি দেড়া ভাড়ার বেশি কোনমতেই যাবো না।

সুতরাং সেইরূপ ব্যবস্থাই হইয়াছিল।

সম্পূর্ণ দুটা দিন সুরেশের দেখা নাই। কিন্তু আজ সকালে দুর্যোগের জন্যই হোক বা অপর কোন কারণেই হোক, সে তাহার পড়িবার ঘরে ছিল। এই আনন্দহীন কক্ষের মধ্যে অচলা ঠিক যেন একটা বসন্তের দমকা বাতাসের মত গিয়া প্রবেশ করিল। তাহার কণ্ঠস্বরে আনন্দের আতিশয্য উপচাইয়া পড়িতেছিল, বলিল, সুরেশবাবু, এ জন্মে আমাদের আর মুখ দেখবেন না নাকি? এত বড় অপরাধটা কি করেছি, বলুন ত?

সুরেশ চিঠি লিখিতেছিল, মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহাদের বাড়ি পুড়িয়া গেলে আশেপাশের গাছগুলার যে চেহারা অচলা আসিবার দিন চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছিল, সুরেশের এই মুখখানা এমনি করিয়াই তাহাদের স্মরণ করাইয়া দিল যে, সে মনে মনে শিহরিয়া উঠিল। বসন্তের হাওয়া ফিরিয়া গেল—সে কি বলিতে আসিয়াছিল, সব ভুলিয়া কাছে আসিয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার কি অসুখ করেচে, সুরেশবাবু? কৈ, আমাকে ত এ কথা বলনি।

শুধু পলকের নিমিত্তই সুরেশ মুখ তুলিয়াছিল। তৎক্ষণাৎ নত করিয়া কহিল, না, আমার কোন অসুখ করেনি, আমি ভালই আছি; বলিয়া সেই বইখানার পাতা উলটাইতে উলটাইতে পুনরায় কহিল, আজই ত তোমরা যাবে, সমস্ত ঠিক হয়েছে? কতকাল হয়ত আর দেখা হবে না।

কিন্তু মিনিট-খানেক পর্যন্ত অপর পক্ষ হইতে উত্তর না পাইয়া সুরেশ বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া চাহিল। অচলার দুই চক্ষু জলে ভাসিতেছিল, চোখাচোখি হইবামাত্রই বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা টপটপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল।

সুরেশের ধমনীতে উষ্ণ রক্তস্রোত উন্মত্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে তাহার সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া, আপনাকে সংযত করিয়া দৃষ্টি অবনত করিল।

অচলা অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া গাঢ়স্বরে বলিয়া উঠিল, তোমার কখ্‌খনো শরীর ভাল নেই সুরেশবাবু, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।

সুরেশ মাথা নাড়িয়া শুধু বলিল, না।

না, কেন? তোমার জন্যে—কথাটা শেষ হইতে পাইল না। দ্বারের বাহির হইতে বেহারা ডাকিয়া কহিল, বাবু, আপনার চা—বলিতে বলিতে সে পর্দা সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিল এবং পরক্ষণেই অচলা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বাহির হইয়া গেল।

ঘণ্টা-খানেক পরে সে তাহার স্বামীর কক্ষে প্রবেশ করিলে মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ ক’দিন থেকে কোথায় গেছে জানো? পিসীমাকেও কিছু বলে যায়নি; সে কি আজ আমার সঙ্গে দেখা করবে না নাকি?

অচলা আস্তে আস্তে কহিল, আজ ত তিনি বাড়িতেই আছেন।

মহিম কহিল, না। এইমাত্র আমাকে ঝি বলে গেল, সে সকালেই কোথায় বেরিয়ে গেছে।

35 Shares