গৃহদাহ

অচলা ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সেই মেয়েটি তাহার জায়গা ছাড়িয়া দূরে গিয়া বসিয়াছে। অচলা অন্তরের বিরক্তি গোপন করিতে না পারিয়া কহিল, আপনাদের বাড়িতে বুঝি কেউ চা-রুটি খায় না?

মেয়েটি সবিনয়ে হাসিয়া বলিল, হায় হায়, ও দৌরাত্ম্য থেকে বুঝি কোন বাড়ি নিস্তার পেয়েচে ভাবেন? ও ত সবাই খায়।

অচলা কহিল, তবে যে বড় ঘৃণায় সরে বসলেন?

মেয়েটি লজ্জিতস্বরে বলিল, না ভাই, ঘৃণায় নয়—পুরুষেরা ত সমস্ত খায়, তবে আমার শ্বশুর এ-সব পছন্দ করেন না, আর—আমাদের মেয়েমানুষের ত—

একদিন এমনি একটা খাওয়া-ছোঁয়ার ব্যাপার লইয়া মৃণালের সহিত তাহার বিচ্ছেদ ঘটিয়াছিল। সেদিনও সে যে-কারণে নিজেকে শাসন করিতে পারে নাই, আজও সে তেমনি একটা অন্তর্জ্বালায় আত্মবিস্মৃত হইয়া গেল, এবং মেয়েটির কথা শেষ না হইতেই রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, আপনাকে বিব্রত করতে আমি চাইনে, আপনি স্বচ্ছন্দে ফিরে এসে আপনার জায়গায় বসুন; বলিয়া চক্ষের নিমিষে চা এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য জানালা দিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। মেয়েটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে চাহিয়া কাঠের মত বসিয়া রহিল, তাহার পরে একেবারে সম্পূর্ণ মুখ ফিরাইয়া বসিয়া আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল। বোধ করি, সে ইহাই ভাবিল, এতক্ষণের এত আলাপ, এত কথাবার্তার যে বিন্দুমাত্র মর্যাদা রাখিল না, না জানি সে এ অশ্রু দেখিয়া আবার কি একটা করিয়া বসিবে।

কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামিলেও আকাশে ঘন মেঘ উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল। অপরাহ্ণের কাছাকাছি পুনরায় চাপিয়া জল আসিল। এই জলের মধ্যে মেয়েটি নামিয়া যাইবে, সে তাহার উদ্যোগ-আয়োজন করিতে লাগিল।

অচলা আর স্থির থাকিতে না পারিয়া, একেবারে তাহার কাছে আসিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, নিজের ব্যবহারের জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত। আমাকে আপনি মাপ করুন।

মেয়েটি হাসিল, কিন্তু সহসা উত্তর দিতে পারিল না।

অচলা পুনরায় কহিল, আমার মন খারাপ থাকলে কি যে করে ফেলি, তার কোন ঠিকানা থাকে না। স্বামী পীড়িত, তাঁকে নিয়ে হাওয়া বদলাতে যাচ্ছি, ভাল হন ভালই, না হলে ঐ বিদেশে কি যে হবে, তা শুধু ভগবানই জানেন। বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠ আর্দ্র হইয়া উঠিল।

মেয়েটি বিস্মিত হইয়া কহিল, কিন্তু আপনার স্বামীকে দেখলে ত পীড়িত বলে মনে হয় না।

অচলা কহিল, আমার স্বামী এই গাড়িতেই আছেন, কিন্তু আপনি তাঁকে দেখেন নি। উনি আমার স্বামীর বন্ধু।

মেয়েটি অধিকতর আশ্চর্য হইয়া চুপ করিয়া রহিল।

এই বন্ধুটি তাঁহার স্বামী কি না, জিজ্ঞাসা করায় সে যে হুঁ বলিয়া সায় দিয়াছিল, এ কথা অচলার মনেই ছিল না, কিন্তু মেয়েটি তাহা বিস্মৃত হয় নাই। কিন্তু তাহার বিস্ময়কে অচলা সম্পূর্ণ অন্যভাবে গ্রহণ করিল। সুরেশের সহিত তাহার আচরণ ও বাক্যালাপে সে নিজের অন্তরে জ্বালা দিয়া বিকৃত করিয়া হিন্দুনারীর চক্ষে ইহা কিরূপ বিসদৃশ দেখাইয়াছে, তাহাই কল্পনা করিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল এবং একান্ত নিরর্থক ও বিশ্রী জবাবদিহির স্বরূপে বলিয়া ফেলিল, আমরা হিন্দু নই—ব্রাহ্ম।

মেয়েটি তবুও মৌন রহিল দেখিয়া অচলা সসঙ্কোচে তাহার হাতখানি ছাড়িয়া দিয়া কহিল, আমাদের আচার-ব্যবহার আপনারা সমস্ত বুঝতে না পারলেই আমাদের অদ্ভুত বলে ভাববেন না।

এইবার মেয়েটি হাসিল, কহিল, আমরা ত ভাবিনে, বরঞ্চ আপনারাই যে-কোন কারণে হোক আমাদের থেকে দূরে থাকতে চান। কেমন করে জানলুম? আমাদেরই দুই-একটি আত্মীয় আছেন, যাঁরা আপনাদের সমাজের। তাঁদের কাছ থেকেই আমি জানতে পেরেচি, বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, সে কারণটি কি?

মেয়েটি কহিল, সে আপনি নিশ্চয়ই জানেন। না জানেন ত সমাজের কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন, বলিয়া হাসিয়া প্রসঙ্গটা অকস্মাৎ চাপা দিয়া কহিল, আচ্ছা, অত দূরে না গিয়ে আপনার স্বামীকে নিয়ে কেন আমাদের ওখানে আসুন না।

কোথায়, আরায়?

মা গো! সেখানে কি মানুষ থাকে! আমার উনি ঠিকেদারী কাজ করেন বলেই আমাকে মাঝে মাঝে আরায় গিয়ে থাকতে হয়। আমি ডিহরীর কথা বলচি। শোন নদীর ওপর আমাদের ছোট বাড়ি আছে, সেখানে দু’দিন থাকলে আপনার স্বামী ভাল হয়ে যাবেন। যাবেন সেখানে? বলিয়া মেয়েটি অচলার হাত-দুটি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া উত্তরের আশায় তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

এই অপরিচিতার ঔৎসুক্য ও আন্তরিক আগ্রহ দেখিয়া অচলা মুগ্ধ হইয়া গেল। কহিল, কিন্তু আপনার স্বামীর ত অনুমতি চাই! তিনি না বললে ত যেতে পারিনে।

মেয়েটি মাথা নাড়িয়া বলিল, ইস, তাই বৈ কি! আমরা সেবা করতে দাসী বলে বুঝি সব তাতেই দাসী? মনেও করবেন না। হুকুম দেবার বেলায় আমরাই ত কর্তা। সে দেশ পছন্দ না হলে সোজা ডিহরীতে চলে আসবেন—এতটুকু চিন্তা করবেন না, এই আপনাকে বলে দিলুম। অনুমতি নিতে হয় আমি নেব, আপনার কি গরজ? বলিয়া এই স্বামী-সৌভাগ্যবতী মেয়েটি তাহার আনন্দের আতিশয্যে অচলাকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল।

আরা স্টেশন নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে, তাহা ট্রেনের মন্দগতিতে বুঝা গেল। সে অচলার হাত-দুটি পুনরায় নিজের ক্রোড়ের মধ্যে টানিয়া লইয়া আবেশভরে বলিল, আমার সময় হল, আমি চললুম, কিন্তু আপনি ভেবে ভেবে মিথ্যে মন খারাপ করতে পাবেন না বলে যাচ্ছি। আপনার কোন ভয় নেই, স্বামী আপনার খুব শিগ্‌গির ভাল হয়ে উঠবেন। কিন্তু কথা দিন, ফেরবার পথে একটিবার আমার ওখানে পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন?

অচলা চোখের জল চাপিয়া বলিল, সেদিন যদি পাই, নিশ্চয় আপনাকে একবার দেখে যাবো।

মেয়েটি বলিল, পাবেন বৈ কি, নিশ্চয় পাবেন। আপনাকে আমি চিনতে পেরেচি। এই আমি বলে যাচ্চি, আপনার এত বড় ভক্তি-ভালবাসাকে ভগবান কখনো বিমুখ করবেন না; এমন হতেই পারে না।

35 Shares