গৃহদাহ

অচলা জবাব দিতে পারিল না, মুখ ফিরাইয়া একটা উচ্ছ্বসিত বাষ্পোচ্ছ্বাস সংবরণ করিয়া লইল।

বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি আসিয়া প্লাটফর্মে থামিল। মেয়েটির ছোট দেবর অন্যত্র ছিল, সে আসিয়া গাড়ির দরজা খুলিয়া দাঁড়াইল। অচলা তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া চুপি চুপি কহিল, আপনার স্বামীর নাম ত মুখে আনবেন না জানি, কিন্তু আপনার নিজের নামটি কি বলুন ত? যদি কখনো ফিরে আসি, কি করে আপনার খোঁজ পাব?

মেয়েটি মৃদু হাসিয়া কহিল, আমার নাম রাক্ষুসী। ডিহরীতে এসে কোন বাঙালীর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেই সে আমার সন্ধান বলে দেবে। কিন্তু দু’জনে একবার এসো ভাই। আমার মাথার দিব্যি রইল, আমি পথ চেয়ে থাকবো। শোন নদীর উপরেই আমাদের বাড়ি। এই বলিয়া মেয়েটি দুই হাত জোড় করিয়া হঠাৎ একটা নমস্কার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে বাহির হইয়া গেল।

বাষ্পীয় শকট আবার ধীরে ধীরে যাত্রা করিল। এইমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে; কিন্তু অবিশ্রাম বারিপাতের সঙ্গে বাতাস যোগ দিয়া এই দুর্যোগের রাত্রিকে যেন শতগুণ ভীষণ করিয়া তুলিয়াছে। জানালার কাচের ভিতর দিয়া চাহিয়া তাহার দৃষ্টি পীড়িত হইয়া উঠিল—তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, এই সূচীভেদ্য অন্ধকার তাহার আদি-অন্ত যেন গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। আলোর মুখ, আনন্দের মুখ আর সে কখনও দেখিবে না—ইহা হইতে এ জীবনে আর তাহার মুক্তি নাই। সঙ্গিবিহীন নির্জন কক্ষের মধ্যে সে একটা কোণের মধ্যে আসিয়া গায়ের কাপড়টা আগাগোড়া টানিয়া দিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল এবং এইবার তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কেন যে এই চোখের জল, ঠিক কি যে তাহার এত বড় দুঃখ, তাহাও সে ভাবিয়া পাইল না, কিন্তু কান্নাকেও সে কোনমতে আয়ত্ত করিতে পারিল না। অদম্য তরঙ্গের মত সে তাহার বুকের ভিতরটা যেন চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া গর্জিয়া ফিরিতে লাগিল। তাহার পিতাকে মনে পড়িল, তাহার ছেলেবেলার সঙ্গী-সাথীদের মনে পড়িল, পিসীমাকে মনে পড়িল, মৃণালকে মনে পড়িল, এইমাত্র যে মেয়েটি রাক্ষুসী বলিয়া নিজেকে পরিচয় দিয়া গেল, তাহাকে মনে পড়িল,—যদু চাকরটা পর্যন্ত যেন তাহার চোখের উপর দিয়া বার বার আনাগোনা করিয়া বেড়াইতে লাগিল। সকলের নিকট সে যেন জন্মের শোধ বিদায় লইয়া কোথায় কোন্‌ নিরুদ্দেশে যাত্রা করিয়াছে, বক্ষের মধ্যে তাহার এমনি ব্যথা বাজিতে লাগিল।

এইভাবে নিরন্তর অশ্রুবিসর্জন করিয়া, গাড়ি যখন পরের স্টেশনে আসিয়া থামিল, তখন বেদনাতুর হৃদয় তাহার অনেকটা শান্ত হইয়া গিয়াছে। সে উঠিয়া বসিয়া ব্যাকুলদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল, যদি কোন স্ত্রীলোক যাত্রী এই দুর্যোগের রাত্রেও তাহার কক্ষে দৈবাৎ পদার্পণ করে। ভিজিতে ভিজিতে কেহ কেহ নামিয়া গেল, কেহ কেহ উঠিলও বটে, কিন্তু তাহার কামরার সন্নিকটেও কেহ আসিল না।

গাড়ি ছাড়িলে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া সে তাহার জায়গায় ফিরিয়া আসিল এবং আপাদমস্তক আচ্ছাদিত করিয়া পূর্ববৎ শুইয়া পড়িতেই এবার কোন অচিন্তনীয় কারণে তাহার দুঃখার্ত চিত্ত অকস্মাৎ সুখের কল্পনায় ভরিয়া উঠিল। কিন্তু ইহা নতুন নহে; যেদিন বায়ুপরিবর্তনের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয়, সেদিনও সে এমনি স্বপ্নই দেখিয়াছিল। আজও সে তেমনি তাহার রুগ্ন স্বামীকে স্মরণ করিয়া তাঁহারই স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করিয়া এক অপরিচিত স্থানের মধ্যে আনন্দ ও সুখ-শান্তির জাল বুনিতে বুনিতে বিভোর হইয়া গেল।

কখন এবং কতক্ষণ যে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, তাহার স্মরণ নাই। সহসা নিজের নাম কানে যাইবামাত্রই সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া দেখিল, দ্বারের কাছে সুরেশ দাঁড়াইয়া এবং সেই খোলা দরজার ভিতর দিয়া অজস্র জল-বাতাস ভিতরে ঢুকিয়া প্লাবনের সৃষ্টি করিয়াছে।

সুরেশ চিৎকার করিয়া কহিল, শিগ্‌গির নেমে পড়, প্লাটফর্মে গাড়ি দাঁড়িয়ে। তোমার নিজের ব্যাগটা কোথায়?

অচলার দুই চক্ষে ঘুম তখনও জড়াইয়াছিল, কিন্তু তাহার মনে পড়িল, এলাহাবাদ স্টেশনে জব্বলপুরের গাড়ি বদল করিতে হইবে। সে ব্যাগটা দেখাইয়া দিয়া শশব্যস্তে নামিয়া পড়িয়া ব্যাকুল হইয়া কহিল, কিন্তু এত জলের মধ্যে তাঁকে নামাবে কি করে? এখানে পালকি-টালকি কিছু কি পাওয়া যায় না? নইলে অসুখ যে বেড়ে যাবে সুরেশবাবু।

সুরেশ কি যে জবাব দিল, জলের শব্দে তাহা বুঝা গেল না। সে এক হাতে ব্যাগ ও অপর হস্তে অচলার একটা হাত দৃঢ়মুষ্টিতে চাপিয়া ধরিয়া ও-দিকের প্লাটফর্মের উদ্দেশ্যে দ্রুতবেগে টানিয়া লইয়া চলিল। এই ট্রেনটা ছাড়িবার জন্য প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল, তাহারই একটা যাত্রিশূন্য ফার্স্টক্লাস কামরার মধ্যে অচলাকে ঠেলিয়া দিয়া সুরেশ তাড়াতাড়ি কহিল, তুমি স্থির হয়ে বসো, তাকে নামিয়ে আনি গে।

তা হলে আমার এই মোটা গায়ের কাপড়টা নিয়ে যাও, তাঁকে বেশ করে ঢেকে এনো। বলিয়া অচলা হাত বাড়াইয়া তাহার গাত্রবস্ত্রটা সুরেশের গায়ের উপর ফেলিয়া দিতেই সে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল।

অন্ধকারে যতদূর দৃষ্টি যায়, অচলা সম্মুখে চাহিয়া দেখিতে লাগিল, পোস্টের উপর দূরে দূরে স্টেশনের লণ্ঠন জ্বলিতেছে; কিন্তু এই প্রচণ্ড জলের মধ্যে যে আলোক এমনি অস্পষ্ট ও অকিঞ্চিৎকর যে, তাহার সাহায্যে কিছুই প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। জলে ভিজিয়া যাত্রীরা ছুটাছুটি করিতেছে, কুলীরা মোট বহিয়া আনাগোনা করিতেছে, কর্মচারীরা বিব্রত হইয়া উঠিয়াছে—ঝাপসা ছায়ার মত তাহা দেখা যায় মাত্র। ক্রমশঃ তাহাও বিরল হইয়া আসিল, স্টেশনের ঘণ্টা তীক্ষ্ণরবে বাজিয়া উঠিল এবং যে ট্রেন হইতে অচলা এইমাত্র নামিয়া আসিয়াছে, ভীষণ অজগরের ন্যায় ফোঁসফোঁস শব্দে তাহা আকাশ-বাতাস কম্পিত করিয়া প্লাটফর্ম ত্যাগ করিয়া বাহির হইয়া গেল এবং অখণ্ড অন্ধকার ব্যতীত সম্মুখে আর কোন ব্যবধানই রহিল না।

35 Shares