গৃহদাহ

অচলা বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়াই বুঝিল, কথাটা সত্য। গাড়ি চলিতে শুরু করিয়াছে। তাহার দুই চক্ষে নিরাশা যেন মূর্তি ধরিয়া দেখা দিল। সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া সেই দৃষ্টি দিয়া শুধু পলকের জন্য সুরেশের একান্ত পাণ্ডুর শ্রীহীন মুখের প্রতি চাহিল এবং পরক্ষণেই ছিন্নমূল তরুর ন্যায় সশব্দে মেঝেয় লুটাইয়া পড়িয়া দুই বাহু দিয়া সুরেশের পা জড়াইয়া কাঁদিয়া উঠিল, কোথায় তিনি? তাঁকে কি তুমি ঘুমন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েচ? রোগা মানুষকে খুন করে তোমার—

এতবড় ভীষণ অভিযোগের শেষটা কিন্তু তখনও শেষ হইতে পাইল না। অকস্মাৎ তাহার বুক-ফাটা কান্না যেন শতধারে ফাটিয়া সুরেশকে একেবারে পাষাণ করিয়া দিয়া চতুর্দিকে ইহারই মত ভয়াবহ এক উন্মত্ত যামিনীর অভ্যন্তরে গিয়া বিলীন হইয়া গেল এবং সেইখানে, সেই গদি-আঁটা বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়া সুরেশ অসহ্য বিস্ময়ে শুধু স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। তার পরে তাহার পদতলে কি যে ঘটিতেছিল, কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাহা যেন উপলব্ধি করিতেই পারিল না। অনেকক্ষণ পরে সে পা-দুটা টানিয়া লইবার চেষ্টা করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, এ কাজ আমি পারি বলে তোমার বিশ্বাস হয়?

অচলা তেমনি কাঁদিতে কাঁদিতে জবাব দিল, তুমি সব পারো। আমাদের ঘরে আগুন দিয়ে তুমি তাঁকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলে। তুমি কোথায় কি করেচ, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বল; বলিয়া সে আর একবার তাহার পা-দুটা ধরিয়া তাহারই পরে সজোরে মাথা কুটিতে লাগিল। কিন্তু পা-দুটা যাহার, সে কিন্তু একেবারে অবশ অচেতনের ন্যায় কেবল নিঃশব্দে চোখ মেলিয়া চাহিল।

বাহিরে মত্ত রাত্রি তেমনি দাপাদাপি করিতে লাগিল, আকাশের বিদ্যুৎ তেমনি বারংবার অন্ধকার চিরিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে লাগিল, উচ্ছৃঙ্খল ঝড়-জল তেমনিভাবেই সমস্ত পৃথিবী লণ্ডভণ্ড করিয়া দিতে লাগিল, কিন্তু এই দুটি অভিশপ্ত নর-নারীর অন্ধ-হৃদয়তলে যে প্রলয় গর্জিয়া ফিরিতে লাগিল, তাহার কাছে এ-সমস্ত একেবারে তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হইয়া বাহিরেই পড়িয়া রহিল।

সহসা অচলা তাহার ভূ-শয্যা ছাড়িয়া তীরবেগে উঠিয়া দাঁড়াতেই সুরেশের যেন স্বপ্ন ছুটিয়া গেল। সে চাহিয়া দেখিল, পরের স্টেশন সন্নিকটবর্তী হওয়ায় গাড়ির বেগ হ্রাস হইয়া আসিয়াছে। অচলা কেন যে এমন করিয়া দাঁড়াইল, তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না। প্রবল চেষ্টায় আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া সুরেশ ডান হাত বাড়াইয়া তাহাকে বাধা দিয়া বলিল, বস। মহিম এ গাড়িতে নেই।

নেই! তবে কোথায় তিনি? বলিতে বিলিতে অচলা সম্মুখের বেঞ্চের উপর ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল।

সুরেশ লক্ষ্য করিয়া দেখিল তাহার মুখের উপর হইতে রক্তের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বোধ করি, এতক্ষণের এত কান্নাকাটি, এত মাথা-কোটাকুটির মধ্যেও হৃদয়ে, তাহার সমস্ত প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধেও একপ্রকার অব্যক্ত অন্তর্নিহিত আশা ছিল, হয়ত এ-সকল আশঙ্কা সত্য নহে, হয়ত প্রচণ্ড দুঃস্বপ্নের দুঃসহ বেদনা ঘুমভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে ই শুধু কেবল একটা দীর্ঘনিশ্বাসেই অবসান হইয়া গিয়া পুলকে সমস্ত চরাচর রাঙা হইয়া উঠিবে। এমনি কিছু একটা অচিন্তনীয় পদার্থ হয়ত তখনও তাহার আগাগোড়া বুক খালি করিয়া দিয়া বিদায় গ্রহণ করে নাই। কেননা, এই ত তখন পর্যন্তও তাহার সংসারে যাহা-কিছু কামনার সমস্ত বজায় ছিল; অথচ একটা রাত্রিও পোহাইল না, আর তাহার কিছু নাই—একেবারে কিছু নাই। চক্ষের পলক ফেলিতে না ফেলিতে জীবনটা একেবারে দুর্ভাগ্যের শেষ-সীমা ডিঙাইয়া বাহির হইয়া গেল! এতবড় পরিমাণবিহীন বিপত্তিতে তাহার বাঁচিয়া থাকাটাই বোধ করি কোনমতে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। উভয়ে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। গাড়ি আসিয়া একটা অজানা স্টেশনে লাগিল এবং অল্পকাল পরে ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

সুরেশ একবার কি একটা বলিবার চেষ্টা করিয়া আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া এবার উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং জানালার কাচ তুলিয়া দিয়া কয়েকবার পায়চারি করিয়া সহসা অচলার সম্মুখে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, মহিম ভাল আছে। এতক্ষণে বোধ হয় সে এলাহাবাদে পৌঁছেছে। একটুখানি থামিয়া বলিল, ওখান থেকে জব্বলপুরেও যেতে পারে, কলকাতায়ও ফিরে আসতে পারে।

অচলা ধীরে ধীরে মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

সেই অশ্রু-কলঙ্কিত মুখের উপর দুঃখ-নিরাশার চরম প্রতিমূর্তি আর-একবার সুরেশের চোখে পড়িল। তাহার ভুল যে কত বড় হইয়া গিয়াছে, এ কথা আর তাহার অগোচর ছিল না এবং ইহার জন্য আজ সে নিজেকে হত্যা করিয়া ফেলিতেও পারিত। কিন্তু যাহার সহস্র ছলনা তাহার সত্য দৃষ্টিকে এমন করিয়া আবৃত করিয়া এই ভুলের মধ্যেই বারংবার অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়াছে, সেই ছলনাময়ীর বিরুদ্ধেও তাহার সমস্ত অন্তর একেবারে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। তাই আজ সে অচলার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিক্তস্বরে বলিয়া উঠিল, বোধ হয় আমরা সশরীরে নরকেই যাচ্চি। যে অধঃপথে পথ দেখিয়ে এতদূর পর্যন্ত টেনে এনেচ, তার মাঝখানে ত ইচ্ছে করলেই দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যাবে না! এখন শেষ পর্যন্ত যেতেই হবে।

কথা শুনিয়া অচলার আপাদমস্তক একবার কাঁপিয়া উঠিল, তার পরে সে নিরুত্তরে মাথা হেঁট করিয়া রহিল। যে মিথ্যাচারী কাপুরুষ পরস্ত্রীকে এমন করিয়া বিপথে ভুলাইয়া আনিয়াও অসঙ্কোচে এত বড় নির্লজ্জ অপবাদ মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতে পারে, তাহাকে বলিবার আর কাহার কি থাকে!

সুরেশ আবার পায়চারি করিতে লাগিল। বোধ হয় এই পাষাণ-প্রতিমার সুমুখে দাঁড়াইয়া কথা কহিবার তাহার শক্তি ছিল না। বলিতে লাগিল, তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছ, যেন একা তোমারই সর্বনাশ! কিন্তু সর্বনাশ বলতে যা বোঝায়, তা আমার পক্ষে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানো? আমি তোমাদের মত ব্রহ্মজ্ঞানী নই, আমি নাস্তিক। আমি পাপপুণ্যের ফাঁকা আওয়াজ করিনে, আমি নিরেট সত্যিকার সর্বনাশের কথাই ভাবি। তোমার রূপ আছে, চোখের জল আছে, মেয়েমানুষের যা-কিছু অস্ত্র-শস্ত্র তোমার তূণে সে-সব প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আছে, তোমার কোন পথেই বাধা পড়বে না। কিন্তু আমার পরিণাম কল্পনা করতে পারো? আমি পুরুষমানুষ—তাই আমাকে জেলের পথ বন্ধ করতে নিজের হাতে এইখানে গুলি করতে হবে। বলিয়া সুরেশ থমকিয়া দাঁড়াইয়া বুকের মাঝখানে হাত দিয়া দেখাইল।

35 Shares