গৃহদাহ

রাক্ষুসী বলিল, কোথায় ঘরের মধ্যে। যাঁর জন্যে ঘর, তিনি যে তখন বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। উঠান থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, ঠিক এমনি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। বলিয়া একটু থামিয়া হাসিমুখে বলিল, কিন্তু তুমি ত আর তোমাতে ছিলে না ভাই, যে বুড়ো-সুড়োর ডাক শুনতে পাবে! যা ভেবেছিলে, তা যদি বলি ত—

অচলা নীরবে পুনরায় নদীর পরপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল, এই-সকল ব্যঙ্গোক্তির উত্তর দিবার চেষ্টামাত্র করিল না। কিন্তু এইখানে বলিয়া রাখা প্রয়োজন যে, রাক্ষুসী নামের সহিত তাহার স্বভাবের বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য ছিল না; এবং নামও তাহার রাক্ষুসী নয়, বীণাপাণি। জন্মকালে মা মরিয়াছিল বলিয়া পিতামহী রাগ করিয়া এই অপবাদ দিয়াছিলেন, এবং প্রতিবেশী ও শ্বশুর-শাশুড়ির নিকট হইতে এ দুর্নাম সে গোপন রাখিতে পারে নাই।

অচলাকে অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া নির্বাক হইতে দেখিয়া সে মনে মনে লজ্জা পাইল, অনুতপ্ত-স্বরে বলিল, আচ্ছা সুরমাদিদি, তোমাকে কি একটা ঠাট্টাও করবার জো নেই ভাই? আমি কি জানিনে, বাবাকে তুমি কত ভক্তি-শ্রদ্ধা কর? তাঁর কাছে ত আমরা সমস্ত শুনেচি।

তিনি সকালে বেড়িয়ে আসছিলেন, আর তুমি এই অজানা জায়গায় কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার খুঁজতে ছুটেছিলে। তারপরে তিনি তোমার সঙ্গে গিয়েই সরাই থেকে তোমার স্বামীকে বাড়ি নিয়ে এলেন। এ সবই ভগবানের কাজ দিদি, নইলে এ বাড়িতে যে তোমাদের পায়ের ধুলো পড়বে, সেদিন গাড়িতে এ কথা কে ভেবেছিল? কিন্তু আমার প্রশ্নের ত জবাব হলো না। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলুম, আমাদের এখানে যে তোমার একদণ্ডও ভাল লাগচে না, সে আমি টের পেয়েচি। কিন্তু কেন? কি কষ্ট, কি অসুবিধে এখানে তোমাদের হচ্ছে ভাই, তাই কেবল জানতে চাইচি; বলিয়া পূর্বের মত এবারও ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া হঠাৎ এই মেয়েটির মনে হইল, যে-কোন কারণেই হোক, সে উত্তরের জন্য মিথ্যা প্রতীক্ষা করিয়া আছে। তখন যাহাকে তাহার শ্বশুর সসম্মানে আশ্রয় দিয়াছেন এবং সে নিজে সুরমাদিদি বলিয়া ভালবাসিয়াছে, তাহার মুখখানা জোর করিয়া টানিয়া ফিরাইবামাত্রই দেখিতে পাইল, তাহার দুই চক্ষের কোণ বাহিয়া নিঃশব্দে অশ্রুর ধারা বহিয়া যাইতেছে; বীণাপাণি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল এবং অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া শূন্যদৃষ্টি অন্যত্র সঞ্চারিত করিল।

পরদিন অপরাহ্নবেলায় সদ্যপ্রাপ্ত একখানা মাসিকপত্র হইতে একটা ছোটগল্প বীণাপাণি অচলাকে পড়িয়া শুনাইতেছিল। একখানা বেতের চৌকির উপর অর্ধশায়িতভাবে বসিয়া অচলা কতক-বা শুনিতেছিল, কতক-বা তাহার কানের মধ্যে একেবারেই পৌঁছিতেছিল না, এমনি সময়ে বীণাপাণির শ্বশুর রামচরণ লাহিড়ী মহাশয় সিঁড়ি হইতে ‘মা রাক্ষুসী’ বলিয়া উপস্থিত হইলেন। উভয়েই শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বীণাপাণি একখানি চৌকি টানিয়া বৃদ্ধের সন্নিকটে স্থাপিত করিয়া উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাবা?

এই বৃদ্ধ অত্যন্ত নিষ্ঠাবান্‌ হিন্দু। তিনি ধীরে-সুস্থে আসন গ্রহণ করিয়া অচলার মুখের প্রতি সস্নেহ প্রশান্ত দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, একটা কথা আছে মা। ভট্‌চায্যিমশাই এইমাত্র এসেছিলেন, তিনি তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর নামে সঙ্কল্প করে নারায়ণকে তুলসী দিচ্ছিলেন, তা কাল শেষ হবে। তবে কাল তোমাকে মা, কষ্ট স্বীকার করে একটু বেলা পর্যন্ত অভুক্ত থাকতে হবে। তিনি আমাদের বাড়িতেই নারায়ণ এনে কাজ সমাপ্ত করে যাবেন, আর কোথাও তোমাকে যেতে হবে না। কথা শুনিয়া অচলার সমস্ত মুখ একেবারে কালিবর্ণ হইয়া উঠিল। ম্লান আলোকে বৃদ্ধের তাহা নজরে পড়িল না, কিন্তু বীণাপাণির পড়িল। সে হিন্দুঘরের মেয়ে, জন্মকাল হইতে এই সংস্কারের মধ্যেই মানুষ হইয়াছে এবং পীড়িত স্বামীর কল্যাণে ইহা যে কত উৎসাহ ও আনন্দের ব্যাপার, তাহা সে সংস্কারের মতই বুঝে, কিন্তু অচলার মুখের চেহারার এই উৎকট পরিবর্তনে তাহার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। তথাপি সখীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা বাবা, নারায়ণকে তুলসী দেওয়ালে ত তুমি সুরেশবাবুর জন্যে, তবে উনি উপোস না করে দিদিকে করতে হবে কেন?

বৃদ্ধ সহাস্যে কহিলেন, তিনি আর তোমার এই দিদিটি কি আলাদা মা? সুরেশবাবু ত তাঁর এ অবস্থায় উপবাস করতে পারবেন না, তাই তোমার সুরমাদিদিকেই করতে হবে। শাস্ত্রে বিধি আছে মা, কোন চিন্তা নাই।

অচলা ইহারও প্রত্যুত্তরে যখন হাঁ-না কোন কথাই কহিল না, তখন তাহার এই নিরুদ্যম নীরবতা অকস্মাৎ এই শুভানুধ্যায়ী বৃদ্ধেরও যেন চোখে পড়িয়া গেল। তিনি সোজা অচলার মুখের প্রতি চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, এতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে সুরমা? বলিয়া একান্ত ও পুনঃ পুনঃ প্রতিবাদের প্রত্যাশায় চাহিয়া রহিলেন।

অচলা সহসা ইহারও কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারিল না। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে কহিল, তাঁকে বললে তিনিই করবেন বোধ হয়।

তাহার পরে সকলেই নীরব হইয়া রহিল। কথাটা যে কিরূপ বিসদৃশ, কত কটু ও নিষ্ঠুর শুনাইল, তাহা যে ব্যক্তি উচ্চারণ করিল, তাহার অপেক্ষা বোধ করি কেহই অনুভব করিল না, কিন্তু শুধু অন্তর্যামী ভিন্ন সে কথা আর কেহ জানিতে পারিল না।

বৃদ্ধ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, তবে তাই হবে, বলিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া গেলেন। ভৃত্য আলো দিয়া গেল, কিন্তু দুজনেই সঙ্কুচিত ও কুণ্ঠিত হইয়া তেমনি নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। মাসিকপত্রে সেই অত বড় উত্তেজক ও বলশালী গল্পের বাকিটুকু শেষ করিবার মত জোরও কাহারও মধ্যে রহিল না।

বাহিরের অন্ধকার গাঢ় হইয়া উঠিতে লাগিল এবং তাহাই ভেদ করিয়া পরপারের ধূসর সৈকতভূমি এক হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এই দুইটি ক্ষুব্ধ মৌন লজ্জিত নারীর চক্ষের উপর স্বপ্নের মত ভাসিতে লাগিল।

35 Shares