গৃহদাহ

এইভাবেই হয়ত আরও বহুক্ষণ কাটিতে পারিত, কিন্তু কি ভাবিয়া বীণাপাণি সহসা তাহার চৌকিটা অচলার পাশে টানিয়া আনিল এবং নিজের ডান হাতখানি সখীর কোলের উপর ধীরে ধীরে রাখিয়া চুপি চুপি কহিল, ও-পারের ওই চরটার পানে চেয়ে চেয়ে আমার কি মনে হচ্ছিল জান দিদি? মনে হচ্ছিল যেন ঠিক তুমি। যেন অমনি অন্ধকার দিয়ে ঘেরা একটুখানি—ও কি, এমন শিউরে উঠলে কেন ভাই?

অচলা মুহূর্তকাল নির্বাক থাকিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, হঠাৎ কেমন যেন শীত ক’রে উঠল ভাই।

বীণাপাণি উঠিয়া গিয়া ঘরের ভিতর হইতে একখানা গরম কাপড় আনিয়া অচলার সর্বাঙ্গ সযত্নে ঢাকিয়া দিয়া স্বস্থানে বসিল, কহিল, একটা কথা তোমাকে ভারী জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় দিদি, কিন্তু কেমন যেন লজ্জা করে। যদি রাগ না কর ত—

অজানা আশঙ্কায় অচলার বুকের ভিতরটা দুলিতে লাগিল। পাছে বেশি কথা বলিতে গেলে গলা কাঁপিয়া যায়, এই ভয়ে সে শুধু কেবল একটা ‘না’ বলিয়াই স্থির হইল।

বীণাপাণি আদর করিয়া তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিয়া বলিতে লাগিল, এখন যেন তুমি আমার দিদি, আমি তোমার ছোটবোন। কিন্তু সেদিন গাড়িতে ত আমি তোমার কেউ ছিলাম না, তবে কেন নিজের পরিচয় আমার কাছ থেকে অমন করে লুকোতে চেয়েছিলে? যিনি স্বামী, তাঁকে বললে কেউ নয়—বললে, পীড়িত স্বামী অন্য কামরায়, তাঁকে নিয়ে জব্বলপুরে যাচ্ছো, কিন্তু আমাকে ঠকাতে পারনি। আমি ঠিক চিনেছিলাম, উনি তোমার কে। আবার বললে তোমরা ব্রাহ্ম, বলিয়া একবার সে একটু মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, কিন্তু এখন দেখছি, তোমার কর্তাটির পৈতের গোছা দেখলে, বিষ্ণুপুরের পাচক ঠাকুরের দল পর্যন্ত লজ্জা পেতে পারে। আচ্ছা ভাই, কেন এত মিথ্যা কথা বলেছিলে বল ত?

অচলা জোর করিয়া একটু শুষ্ক হাসি হাসিয়া কহিল, যদি না বলি?

বীণাপাণি কহিল, তা হলে আমিই বলব! কিন্তু আগে বল, যদি ঠিক কথাটি বলতে পারি, কি আমাকে দেবে?

অচলার বুকের মধ্যে রক্ত-চলাচল যেন বন্ধ হইয়া যাইবার মত হইল। তাহার মুখের উপরে যে মৃত্যু-পাণ্ডুরতা ঘনাইয়া আসিল, বাতির ক্ষীণ আলোকে বীণাপাণির তাহা চোখে পড়িল কিনা বলা কঠিন, কিন্তু সে মুখ টিপিয়া আবার একটুখানি হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, কিছু দাও আর না দাও, যদি সত্যি কথাটি বলতে পারি, আমাকে কি খাওয়াবে বল অচলাদিদি।

অচলার নিজের নামটা নিজের কানে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় প্রবেশ করিল, এবং পরক্ষণ হইতেই সে একপ্রকার অর্ধচেতনে অর্ধ-অচেতনের মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল।

বীণাপাণি কহিতে লাগিল, আমাদের দুই বোনের কিন্তু তত দোষ নেই ভাই, দোষ যত আমাদের কর্তা দুটির। একজন জ্বরের ঘোরে তোমার সত্যি নামটি প্রকাশ করে দিলেন, আর অপরটি তাই থেকে তোমার সত্যি পরিচয়টি ভেবে বার করে আনলেন।

অচলা প্রাণপণ-বলে তাহার বিক্ষুব্ধ বক্ষকে সংযত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সত্যি পরিচয়টি কি শুনি?

বীনাপাণি বলিল, সত্যি হোক আর নাই হোক ভাই, বুদ্ধি যে তার আছে, সে কিন্তু তোমাকে মানতেই হবে। তিনি একদিন রাত্রে হঠাৎ এসে বললেন, তোমার অচলাদিদির কাণ্ডটা কি জানো গো? তিনি ঘর থেকে পালিয়ে এসেছেন। আমি রাগ করে বললুম, যাও, চালাকি করতে হবে না। এ কথা দিদির কানে গেলে ইহজন্মে আর তিনি তোমার মুখ দেখবেন না।

অচলা চেয়ারের হাতায় দুই মুঠা কঠিন করিয়া বসিয়া রহিল।

বীণাপাণি কহিতে লাগিল, তিনি বললেন, মুখ আমার তিনি দেখুন, আর নাই দেখুন, এ কথা যে সত্য, আমি দিব্য করে বলতে পারি। জা-ননদের সঙ্গে ঝগড়া করেই হোক, আর শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে বনিবনাও না হওয়াতেই হোক, স্বামী নিয়ে তিনি বিবাগী হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। সুরেশবাবুর ত ভাব-গতিক দেখে মনে হয়, তোমার দিদি তাঁকে সমুদ্রে ডুবতে হুকুম করলেও তাঁর না বলার শক্তি নাই। তার পরে যেখানে হোক একটা ছদ্মনামে অজ্ঞাতবাসে দুটিতে থাকবেন, যতদিন না বুড়ো-বুড়িস পৃথিবী খুঁজে সেধে-কেঁদে তাঁদের বৌ-বেটাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এই যদি না আসল ঘটনা হয় ত তুমি আমাকে—

আমি বললুম, আচ্ছা, তাই যেন হলো, কিন্তু গাড়িতে আমার মত একটা অপরিচিত মুখ্যু মেয়েমানুষের কাছে মিথ্যে বলবার দিদির কি এমন গরজ হয়েছিল? কর্তা তাতে হেসে জবাব দিলেন, তোমার দিদিটি যদি তোমার মত বুদ্ধিমতী হতেন, তা হলে হয়ত কোন গরজই হ’ত না। কিন্তু তা তিনি মোটেই নয়। যাই শুনলেন, তোমার বাড়ি ডিহরীতে, তুমি দুদিন পরে ডিহরীতেই যাবে, তখনই তিনি অচলার বদলে সুরমা, ডিহরীর বদলে জব্বলপুরযাত্রী এবং হিন্দুর বদলে ব্রাহ্ম-মহিলা হয়ে উঠলেন। এটা তোমার মাথায় ঢুকল না রাক্ষুসী, যাঁরা টিকিট কিনে জব্বলপুর যাত্রা করে বেরিয়েছেন, তাঁরা হঠাৎ গাড়ি বদল করে এদিকেই বা ফিরবেন কেন, আর পীড়িত স্বামী নিয়ে কোন বাঙালীর বাড়িতে না উঠে ওই অতদূর হিন্দুস্থানী পল্লীতে, একটা ভাঙ্গা সরাইয়ের মধ্যে গিয়েই বা হাজির হবেন কেন? বলিতে বলিতেই বীণাপাণি অকস্মাৎ পার্শ্বে হেলিয়া অচলার গলা জড়াইয়া ধরিল এবং স্নেহে প্রেমে বিগলিত হইয়া তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, বল না দিদি, কি হয়েছিল? আমি কোনদিন কাউকে কোন কথা বলব না—এই তোমাকে ছুঁয়ে আজ আমি দিব্যি করচি।

বীণাপাণির মুখে তাহাদের সম্বন্ধে এই সত্য আবিষ্কারের মিথ্যা ইতিহাস শুনিয়া অচলার সমস্ত দেহটা যেন একখণ্ড অচেতন পদার্থের মত সখীর আলিঙ্গনের মধ্যে ঢলিয়া পড়িল। ইহজীবনের চরম লজ্জা মূর্তি ধরিয়া এক-পা এক-পা করিয়া যে কোথায় অগ্রসর হইয়া আসিয়াছে, তাহা সে চাহিয়া দেখিতেছিল, কিন্তু সে যখন অত্যন্ত অকস্মাৎ অচিন্তনীয়রূপে মুখ ফিরাইয়া আর-এক পথে চলিয়া গেল, তাহাকে স্পর্শমাত্র করিল না, তখন এই বিপুল সৌভাগ্যকে বহন করিবার মত শক্তি আর তাহাতে ছিল না। শুধু দুই চক্ষের অবিশ্রান্ত অশ্রুপ্রবাহ ব্যতীত বহুক্ষণ পর্যন্ত কোথাও জীবনের কোন লক্ষণ আর তাহার মধ্যে অনুভূত হইল না।

35 Shares