গৃহদাহ

এমন কতক্ষণ কাটিল। বীণাপাণি আপন অঞ্চলে বার বার করিয়া অচলার চোখের জল মুছাইয়া দিয়া সস্নেহে করুণস্বরে কহিল, সুরমাদিদি, তুমি বয়সে বড় হলেও ছোটবোনের কথাটা রাখো ভাই, এইবার বাড়ি ফিরে যাও। আমি বলচি, এ যাত্রা তোমাদের সুযাত্রা নয়। অনেক দুঃখে হাতের নোয়াটা যদি বজায় রয়েই গেছে দিদি, তখন অভিমান করে আর গুরুজনদের দুঃখ দিয়ো না, আর তাঁদের ভাবিয়ো না। হেঁট হয়ে শ্বশুর-ঘরে ফিরে যেতে কোন লজ্জা, কোন অগৌরব নেই দিদি।

ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সে পুনরায় কহিল, চুপ করে রইলে যে ভাই। যাবে না? মা-বাপের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে সুরেশবাবু কখনো ভাল নেই। তোমার মুখ থেকে এ কথা শুনলে তিনি খুশিই হবেন, এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলচি।

অচলা চোখ মুছিয়া এইবার সোজা হইয়া বসিল। চাহিয়া দেখিল, বীণাপাণি তেমনি উৎসুক-মুখে তাহার প্রতি চাহিয়া আছে। প্রথমটা উত্তর দিতে তাহার অতিশয় লজ্জা করিতে লাগিল, কিন্তু শুদ্ধমাত্র নির্বাক্‌ রহিয়াই যে ওই মেয়েটির কাছে মুক্তি পাওয়া যাইবে না, তাহাতে যখন আর কোন সংশয় রহিল না, তখন সমস্ত সংকোচ জোর করিয়া পরিত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমাদের বাড়ি ফিরে যাবার কোন পথ নাই বীণা।

বীণাপাণি বিশ্বাস করিল না। কহিল, কোন পথ নেই? তোমাকে আমি বেশীদিন জানিনে সত্যি, কিন্তু যতটুকু জানি, তাতে সমস্ত পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে দিব্যি করে বলতে পারি, তুমি এমন কাজ কখনো করতে পারো না দিদি, যার জন্যে কেউ তোমার কোনদিকের পথ বন্ধ করতে পারে। আচ্ছা, তোমার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা বলে দাও, আমরা ত পরশু সকালের গাড়িতে বাড়ি যাচ্ছি, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমি নিজে তোমাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হব, দেখি বুড়ো-বুড়ি আমাকে কি জবাব দেন। তোমার যাঁরা শ্বশুর-শাশুড়ি, তাঁরা আমারও তাই—তাঁদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আমার কোন লজ্জা নেই।

অচলা চকিত হইয়া কহিল, তোমরা পরশু দেশে যাবে, এ কথা ত শুনিনি? এখানে কে কে থাকবেন?

বীণাপাণি কহিল, কেউ না, শুধু চাকর-দরোয়ান বাড়ি পাহারা দেবে। আমার জাঠ-শাশুড়ি অনেকদিন থেকেই শয্যাগত, তাঁর প্রাণের আশা আর নেই—তিনি সকলকেই একবার দেখতে চেয়েছেন।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, তোমার শ্বশুরবাড়িটি কোথায়?

বীণাপাণি বলিল, কলকাতার পটলডাঙ্গায়।

পটলডাঙ্গা নাম শুনিয়া অচলার মুখ শুষ্ক হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে কহিল, বীণা, তা হলে আমাদেরও এ-বাড়ি ছেড়ে কালই যেতে হয়। এখানে থাকা ত আর চলে না।

বীণাপাণি হাসিয়া উঠিল। বলিল, তাই বুঝি তোমাদের বাড়ি ফেরবার জন্য এত সাধাসাধি করচি? এতক্ষণে বুঝি আমার কথার তুমি এই অর্থ করলে! না দিদি, আমার ঘাট হয়েছে, তোমাকে কোথাও যেতে আর কখনো আমি বলব না; যতদিন ইচ্ছে এই কুঁড়েঘরে তোমরা বাস কর, আমাদের কারও আপত্তি নেই।

কিন্তু এই সদয় নিমন্ত্রণের অচলা কোন উত্তরই দিতে পারিল না। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বিবর্ণমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তোমাদের যাওয়া কি সত্যই স্থির হয়ে গেছে?

বীণাপাণি কহিল, স্থির বৈ কি। আজ আমাদের গাড়ি পর্যন্ত রিজার্ভ করা হয়েচে। বাবার ঘরে যদি একবার উঁকি মারো ত দেখতে পাবে বোধ হয়, পনের-আনা জিনিসপত্রই বাঁধাছাঁদা ঠিকঠাক।

দাসী আসিয়া দ্বার-প্রান্তে দাঁড়াইয়া কহিল, বৌমা, মা একবার তোমাকে রান্নাঘরে ডাকচেন।

যাই, বলিয়া সে একটু হাসিয়া সহসা আর একবার দুই বাহু দিয়া অচলার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া কানে কানে কহিল, এতদিন লোকের ভিড়ে অনেক মুশকিলেই তোমাদের দিন কেটেচে। এবার খালি বাড়ি—কেউ কোথাও নেই—আপদ-বালাই আমিও দূর হয়ে যাবো—এবার বুঝলে না ভাই দিদিমণিটি? বলিয়া সখীর কপোলের উপর দুটি আঙুলের একটু চাপ দিয়াই দ্রুতবেগে দাসীর অনুসরণ করিয়া চলিয়া গেল।

এক টুকরা আনন্দ, খানিকটা দক্ষিণা হাওয়ার মত এই সৌভাগ্যবতী তরুণী লঘুপদে দৃষ্টির বাহিরে অপসৃত হইয়া গেল, কিন্তু তাহার কানে কানে বলা শেষ কথা-দুটি অচলা দুই কানের মধ্যে লইয়া সেইখানে পাষাণ-মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। আজিকার রাত্রি এবং কল্যকার দিনটা মাত্র বাকী । তাহার পরে আর কোন বাধা, কোন বিঘ্ন নাই—এই নির্জন নীরব পুরীর মধ্যে—কাছে এবং দূরে, তাহার যতদূর দৃষ্টি যায়—ভবিষ্যতের মধ্যে চোখ মেলিয়া দেখিল—কেবল একাকী এবং কেবলমাত্র সুরেশ ব্যতীত আর কিছুই তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না।

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

এই জনহীন পুরীর মধ্যে কেবলমাত্র সুরেশকে লইয়া জীবনযাপন করিতে হইবে এবং সেই দুর্দিন প্রতি মুহূর্তে আসন্ন হইয়া আসিতেছে। বাধা নাই, ব্যবধান নাই, লজ্জা নাই—আজ নয় কাল বলিয়া একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিবার পর্যন্ত সুযোগ মিলিবে না।

বীণাপাণি বলিয়াছিল, সুরমাদিদি, শ্বশুর-ঘর আপনার ঘর, সেখানে হেঁট হয়ে যেতে মেয়েমানুষের কোন শরম নেই।

হায় রে, হায়! তাহার কে আছে, আর কি নাই, সে জমাখরচের হিসাব তাহার অন্তর্যামী ভিন্ন আর কে রাখিয়াছে! তথাপি আজও তাহার আপনার স্বামী আছে এবং আপনার বলিতে সেই তাহাদের পোড়া ভিটাটা এখনও পৃথিবীর অঙ্ক হইতে লুপ্ত হইয়া যায় নাই। আজিও সে একটা নিমিষের তরেও তাহার মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে পারে।

আবদ্ধ পশুর চোখের উপর হইতে যতক্ষণ না এই বাহিরের ফাঁকটা একেবারে আবৃত হইয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যেমন সে একই স্থানে বারংবার মাথা কুটিয়া মরিতে থাকে, ঠিক তেমনি করিয়াই তাহার অবাধ্য মনের প্রচণ্ড কামনা তাহার বক্ষের মধ্যে হাহাকার করিয়া বাহিরের জন্য পথ খুঁজিয়া মরিতে লাগিল। পার্শ্বের ঘরে সুরেশ নিরুদ্বেগে নিদ্রিত, মধ্যের দরজাটা ঈষৎ উন্মুক্ত এবং তাহারই এ-ধারে মেঝের উপর মাদুর পাতিয়া আপনার আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকিয়া হিন্দুস্থানী দাসী অকাতরে ঘুমাইতেছে। সমস্ত বাটীর মধ্যে কেহ যে জাগিয়া আছে, তাহার আভাসমাত্র নাই—শুধু সেই যেন অগ্নিশয্যার উপরে দগ্ধ হইয়া যাইতে লাগিল। অনেক দিন এই পালঙ্কের উপরেই তাহার পার্শ্বে বীণাপাণি শয়ন করিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার স্বামী উপস্থিত, সে তাহার নিজের ঘরে শুইতে গিয়াছে, এবং পাছে এই চিন্তার সূত্র ধরিয়া নিজের বিক্ষিপ্ত পীড়িত চিত্ত অকস্মাৎ তাহাদেরই অবরূদ্ধ কক্ষের সুষুপ্ত পর্যঙ্কের প্রতি দৃষ্টি হানিয়া হিংসায়, অপমানে, লজ্জার অণু-পরমাণুতে বিদীর্ণ হইয়া মরে, এই ভয়ে সে যেন আপনাকে আপনি প্রচণ্ড শক্তিতে টানিয়া ফিরাইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত দেহটা তার তীব্র তড়িৎস্পৃষ্টের ন্যায় থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

35 Shares