গৃহদাহ

মহিমের বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা রহিল না। সুরেশের আকস্মিক আবেগকম্পিত কণ্ঠস্বর, এই সনির্বন্ধ অনুরোধ, বিশেষ করিয়া ব্রাহ্মমহিলা সম্বন্ধে এই সসম্ভ্রম উল্লেখে সে যেন বিহ্বল হইয়া গেল। কিছুক্ষণ বন্ধুর মুখের পানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে আমার পথ চেয়ে বসে আছে সুরেশ? কেদারবাবুর মেয়ে?

সুরেশ সহসা আপনাকে সামলাইয়া লইয়া বলিল, থাকতেও ত পারেন?

মহিম আবার কিছুক্ষণ সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে যে ইতিমধ্যে ব্রাহ্মবাড়িতে গিয়া অনাহূত পরিচয় করিয়াও আসিতে পারে, এ সম্ভাবনা তাহার কোনমতেই মনে উদয় হইল না। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, না সুরেশ, আমি হার মানছি—তোমার আজকের মেজাজ বাস্তবিক আমার বুদ্ধির অগম্য। ব্রাহ্মমেয়ে পথ চেয়ে বসে আছে, এ কথা তোমার মুখ থেকে বোঝা আমার দ্বারা অসম্ভব।

সুরেশ কহিল, আচ্ছা, সে কথা একদিন বুঝিয়ে দেব। তুমি বল, কাল সকালেই একবার দেখা দেবে?

না, কাল অসম্ভব। আমাকে সকালের গাড়িতেই যেতে হবে।

মিনিট-কয়েকের জন্যও কি দেখা দিতে পার না?

না, তাও পারিনে। কিন্তু তোমার কি হয়েছে বল দেখি?

সে কথা আর একদিন বলব—আজ নয়। আচ্ছা, আমি নিজে গিয়ে তোমার কথা বলে আসতে পারি কি?

মহিম অধিকতর আশ্চর্য হইয়া কহিল, পার, কিন্তু তার ত কিছু দরকার নেই।

সুরেশ কহিল, না থাক দরকার—দরকারই সব নয়। আমার পরিচয় দিলে তাঁরা চিনতে পারবেন?

একজন নিশ্চয়ই পারবেন।

সুরেশ বলিল, তা হলেই যথেষ্ট। তোমার বন্ধু বলে চিনবেন ত?

মহিম বলিল, হাঁ।

সুরেশ এইবার একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, আর চিনবেন—তোমার একজন ঘোরতর ব্রাহ্ম-বিদ্বেষী হিন্দুবন্ধু বলে? না?

মহিম বলিল, কিন্তু সেই ত তোমার প্রধান গর্ব সুরেশ!

সুরেশ বলিল, তা বটে। বলিয়া কিছুক্ষণ মাটির দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আজ আমার বড় ঘুম পাচ্ছে মহিম, আমি শুতে চললুম। বলিয়া অন্যমনস্কের মত ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সুরেশ মনে মনে অসংশয়ে অনুভব করিতেছিল যে, কথাটা মহিম যেমন করিয়াই উড়াইয়া দিক, সে তাহারই একান্ত অনুরোধ উপেক্ষা করিতে না পারিয়াই এতদিন অচলার সহিত দেখা করিতে পারে নাই। সে যত ভালই বাসুক, এখন পর্যন্ত সে একটা ব্রাহ্মমেয়ের কাছে তাহার শৈশবের বন্ধুকে খাটো করিতে পারে না, এমন কথা কাল শুনিলেও সুরেশের বুকখানা গর্বে দশ হাত ফুলিয়া উঠিত। আজ কিন্তু তাহার নির্জন শয্যায় এ চিন্তা তাহাকে লেশমাত্র আনন্দ দিল না। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, একদিন-না-একদিন হাসি-গল্পে উপহাসে-পরিহাসে বিচিত্র হইয়া সমস্ত কথা অচলার কানে উঠিবে। সেদিন সুখের ক্রোড়ে বসিয়া সে তাহার স্বামীর এই অপদার্থ বন্ধুটার নিষ্ফল ঈর্ষার কোন তাৎপর্যই খুঁজিয়া পাইবে না, অথচ হাসির ছলেও সে স্বল্পভাষিণী কোনদিন কোন প্রশ্নই তাহাকে করিবে না। হয়ত-বা, শুধু মনে মনে একটুখানি হাসিয়া বলিবে, এই লোকটা বন্ধুত্বের অতি-অভিমানে কত পণ্ডশ্রমই না করিয়াছে! ব্যর্থ আক্রোশে কত অন্তর্দাহেই না জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিয়াছে!

রাত্রে তাহার সুনিদ্রা হইল না। যতবার ঘুম ভাঙ্গিল, ততবারই এই-সকল তিক্ত চিন্তা তাহাকে ধিক্কার দিয়া বলিয়া গেল—পরের জন্য এমন উৎকট মাথাব্যথার রোগ কবে সারিবে সুরেশ?

সকালবেলা উঠিয়া সে দিনের কোন কাজে মন দিতে পারিল না এবং বেলা বাড়িতে না বাড়িতেই গাড়ি করিয়া কেদারবাবুর বাটীতে উপস্থিত হইল। বেহারা জানাইল, বাবু আলিপুর আদালতে বাহির হইয়া গিয়াছেন—ফিরিতে তিন-চার ঘণ্টা দেরি হইতেও পারে।

সুরেশ ফিরিতে উদ্যত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, দুইজনেই বেরিয়ে গেছেন?

প্রশ্নটা বেহারা বুঝিতে পারিল না। ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে ত আমি জানিনে বাবু।

সুরেশ মুশকিলে পড়িল। গৃহস্বামীর অবর্তমানে তাঁহার যুবতী কন্যার সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রশ্ন করা ব্রাহ্ম-পরিবারের মধ্যে শিষ্টতা-বিরুদ্ধ কি না, তাহা স্থির করিতে পারিল না, অথচ এই কন্যাটিকেই তাহার একমাত্র প্রয়োজন। চিন্তা করিয়া কহিল, তোমার বাবুর ফিরতে এত দেরি নাও হতে পারে ত? আমি এক-আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করেই দেখি।

বেহারা সুরেশকে বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইয়া বলিল, দিদিঠাকরুন বাড়ি আছেন, তাঁকে খবর দেব কি? বলিয়া উত্তরের জন্য চাহিয়া রহিল। অচলা এই ভদ্রলোকটির সুমুখে যে বাহির হন তাহা সে কালই দেখিয়াছিল।

সুরেশ অন্তরের আগ্রহাতিশয্য প্রাণপণে নিবারণ করিয়া নিস্পৃহভাবে কহিল, তাঁকে আবার খবর দেবে? আচ্ছা দাও, ততক্ষণ না হয় তাঁর সঙ্গে দুটো কথা কই।

বেহারা চলিয়া গেল এবং অনতিকাল পরেই অচলা পার্শ্বের দরজার পর্দা সরাইয়া প্রবেশ করিল।

সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, মহিম যে বাড়ি চলে গেল। এত করে বললুম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে—কিন্তু কোনমতেই কথা শুনলে না, এমন একটা—

অচলার মুখ মুহূর্তের জন্য সাদা হইয়া গেল। কিন্তু নমস্কার করিয়া একটা চৌকিতে উপবেশন করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, যাওয়া বোধ করি খুব বেশি দরকার, বাড়িতে কারও অসুখ-বিসুখ করেনি ত?

নমস্কার করিতে দেখিয়া সুরেশ অপ্রতিভ হইয়া প্রতি-নমস্কার করিল; এবং নিজের অনাবশ্যক উত্তেজনার সঙ্গে অচলার শান্ত ধীর কথাগুলি ওজন করিয়া শতগুণ লজ্জিত ও কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া বলিল, দরকার যাই হোক—সে এমন কি ভয়ানক হতে পারে যে, অন্তত: দু’ মিনিটের জন্য এসেও একবার আপনাকে সে বলে যেতে পারে না? আর যখন কবে ফিরবে, তার কোন ঠিকানা নেই, আপনিই বলুন, বাড়িতেই বা তার আছে কে—যার অসুখের জন্যে তাকে এভাবে যেতে হয়? আমি ত মরে গেলেও এমন করে চলে যেতে পারতুম না।

35 Shares