গৃহদাহ

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

একটা কোচের উপর সুরেশ চক্ষু মুদিয়া শুইয়াছিল এবং সন্নিকটে একখানা চৌকি টানিয়া বৃদ্ধ রামবাবু তাহার পীড়িত বক্ষে অগ্নির উত্তাপ দিতেছিলেন, এমন সময়ে উভয়েই দ্বার খোলার শব্দে চাহিয়া দেখিলেন, অচলা প্রবেশ করিতেছে। সে বিনা আড়ম্বরে কহিল, রাত অনেক হয়েছে, জ্যাঠামশাই, আপনি শুতে যান।

সেইজন্যেই ত অপেক্ষা করে আছি মা, বলিয়া বৃদ্ধ চট্‌ করিয়া উঠিয়া পড়িলেন, এবং সুরেশকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, এতক্ষণ দু’জনেরই শুধু কেবল বিড়ম্বনা ভোগ হল বৈ ত নয়! এ-সব কাজ কি আমরা পারি? অচলার প্রতি চেয়ারটা ঈষৎ অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিলেন, যার কর্ম তাকেই সাজে মা, এই নাও, বসো—আমি একটু হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচি। বলিয়া বৃদ্ধ বিপুল শ্রান্তির ভারে মস্ত একটা হাই তুলিয়া গোটা-দুই তুড়ি দিয়া হুঁকাটা তুলিয়া লইলেন, এবং ঘরের বাহির হইয়া সাবধানে দরজা বন্ধ করিতে করিতে সহাস্যে কহিলেন, ঢুলতে ঢুলতে যে হাত-পা পুড়িয়ে বসিনি সেই ভাগ্য, কি বলেন সুরেশবাবু?

সুরেশ কোন কথা কহিল না, শুধু নিমীলিত নেত্রের উপর দুই হাত যুক্ত করিয়া একটা নমস্কার করিল।

অচলা নীরবে তাঁহার পরিত্যক্ত আসনটি অধিকার করিয়া বসিল এবং সেক দিবার ফ্লানেলটা উত্তপ্ত করিতে করিতে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, আবার ব্যথা হলো কেন? কোন্‌খানটায় বোধ হচ্চে?

সুরেশ চোখ মেলিল না, উত্তর দিল না, শুধু হাত তুলিয়া বক্ষের বাম দিকটা নির্দেশ করিয়া দেখাইল। আবার সমস্ত নিস্তব্ধ। সে এমনি যে, মনে হইতে লাগিল, বুঝিবা এই নির্বাক অভিনয়ের শেষ অঙ্ক পর্যন্ত এমনি নীরবেই সমাপ্ত হইবে। কিন্তু সেরূপ ঘটিল না। সহসা অচলার ফ্লানেলসুদ্ধ হাতখানা সুরেশ তাহার বুকের উপর চাপিয়া ধরিল। অচলার মুখের উপর উদ্বেগের কোন চিহ্ন প্রকাশ পাইল না; সে ইহাই যেন প্রত্যাশা করিতেছিল, কেবল কহিল, ছাড়ো, আরও একটু সেক দিয়ে দিই।

সুরেশ হাত ছাড়িয়া দিল, কিন্তু চক্ষের পলকে উঠিয়া বসিয়া দুই ব্যগ্র বাহু বাড়াইয়া অচলাকে তাহার আসন হইতে টানিয়া আনিয়া নিজের বুকের উপর সজোরে চাপিয়া ধরিয়া অজস্র চুম্বনে একেবারে আচ্ছন্ন অভিভূত করিয়া ফেলিল। একমুহূর্ত পূর্বে যেমন মনে হইয়াছিল, এই আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন নাটকের পরিসমাপ্তি হয়ত এমনি নিস্পন্দ মৌনতার ভিতর দিয়াই ঘটিবে, কিন্তু নিমেষ না গত হইতেই আবার বোধ হইতে লাগিল, এই উন্মত্ত নির্লজ্জতার বুঝি সীমা নাই, শেষ নাই, সর্বদিক সর্বকাল ব্যাপিয়াই এই মত্ততা চিরদিন বুঝি এমনি অনন্ত ও অক্ষয় হইয়া রহিবে—কোনদিন কোন যুগেও ইহার আর বিরাম মিলিবে না, বিচ্ছেদ ঘটিবে না।

অচলা বাধা দিল না, জোর করিল না; মনে হইল, ইহার জন্যও সে প্রস্তুত হইয়াই ছিল, শুধু কেবল তাহার শান্ত মুখখানা একেবারে পাথরের মত শীতল ও কঠোর হইয়া উঠিল। সুরেশের চৈতন্য ছিল না—বোধ হয় সৃষ্টির কঠিনতম তমিস্রায় তাহার দুই চক্ষু একেবারে অন্ধ হইয়া গিয়াছিল, না হইলে এ মুখ-চুম্বন করার লজ্জা ও অপমান আজ তাহার কাছে ধরা পড়িতেও পারিত। ধরা পড়িল না সত্য, কিন্তু সুদ্ধমাত্র শান্তিতেই বোধ করি এই উন্মাদনা যখন স্থির হইয়া আসিল, তখন অচলা ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া আপনার জায়গায় ফিরিয়া আসিয়া বসিল।

আরও ক্ষণকাল দু’জনেরই যখন চুপ করিয়া কাটিল, তখন সুরেশ অকস্মাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, অচলা, এমন করে আর আমাদের কতদিন কাটবে? বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই কহিতে লাগিল, তোমার কষ্ট আমি জানি, কিন্তু আমার দুঃখটাও একবার ভেবে দেখ। আমি যে গেলুম।

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়াই অচলা জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি এখানে বাড়ি কিনেচ?

সুরেশ বিপুল আগ্রহে বলিয়া উঠিল, সে ত তোমারই জন্য অচলা!

অচলা ইহার কোন প্রত্যুত্তর না দিয়া পুনশ্চ প্রশ্ন করিল, আসবাবপত্র, গাড়ি-ঘোড়াও কি কিনতে পাঠিয়েচ?

সুরেশ তেমন করিয়াই উত্তর দিল, কিন্তু সমস্তই ত তোমারই জন্যে।

অচলা নীরব হইয়া রহিল। এ-সকলে তাহার কি প্রয়োজন, এ-সকল সে চায় কি না—ওই লোকটার কাছে এ প্রশ্ন করার মত নিজের প্রতি বিদ্রূপ আর কি আছে? তাই এ-সম্বন্ধে আর কোন কথা না কহিয়া মৌন হইয়া রহিল। মুহূর্ত-কয়েক পরে জিজ্ঞাসা করিল, রামবাবুর কাছে কি তুমি আমার বাবার নাম করেচ? বাড়ি কোথায় বলেচ?

সুরেশ বলিল, না।

আর কি সেক দেবার দরকার আছে?

না।

তা হলে এখন আমি চললুম। আমার বড় ঘুম পাচ্চে। বলিয়া অচলা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং আগুনের পাত্রটা সরাইয়া রাখিয়া ঘরের বাহির হইয়া কবাট বন্ধ করিবার উপক্রম করিতেই সুরেশ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, আজ আর একটা কথা বলে যাও অচলা। তুমি কি আর কোথাও যেতে চাও? সত্যি বলো?

অচলা কহিল, সে কোথায়?

সুরেশ বলিল, যেখানে হোক। যেখানে আমাদের কেউ চেনে না, কেউ জানে না—তেমন কোন দেশে। সে দেশ যত—

আগ্রহে আবেশে সুরেশের কণ্ঠস্বর কাঁপিতে লাগিল, অচলা তাহা লক্ষ্য করিল, কিন্তু নিজে সে একান্ত স্বাভাবিক ও সরল গলায় আস্তে আস্তে জবাব দিল, এদেশেও ত আমাদের কেউ চিনত না। আজও ত আমাদের কেউ চেনে না।

সুরেশ উৎসাহ পাইয়া বলিতে গেল, কিন্তু ক্রমশঃ—

অচলা বাধা দিয়া কহিল, ক্রমশঃ জানতে পারবে? খুব সম্ভব পারবে, কিন্তু সে সম্ভাবনা ত অন্য দেশেও আছে?

সুরেশ উল্লাসে চঞ্চল হইয়া বলিতে লাগিল, তা হলে এখানেই স্থির। এখানেই তোমার সম্মতি আছে, বল অচলা? একেবারে স্পষ্ট করে বলে দাও—, বলিতে বলিতে কিসে যেন তাহাকে ঠেলিয়া তুলিয়া দিল। কিন্তু ব্যগ্র পদ মেঝের উপর দিয়াই সে সহসা স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া দেখিল, দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া অচলা অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে।

35 Shares