গৃহদাহ

কয়েকদিন হইতে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হইয়া এক ঝড়-বৃষ্টির সূচনা করিতেছিল। সুরেশের নূতন বাটীতে অপর্যাপ্ত আসবাব ও সাজসরঞ্জাম কলিকাতা হইতে আসিয়া গাদা হইয়া পড়িয়া আছে; তাহাদিগকে সাজাইয়া গুছাইয়া লইবার দিকে কোন পক্ষেরই কোন গা নাই। একজোড়া বড় ঘোড়া ও একখানা অতিশয় দামী গাড়ি পরশু আসিয়া পর্যন্ত কোন্‌ একটা আস্তাবলে সহিস-কোচম্যানের জিম্মায় রহিয়াছে, কেহই খোঁজ লয় না। দিনগুলা যেমন-তেমন করিয়া কাটিয়া চলিয়াছে, এমন সময় একদিন দুপুরবেলায় বৃদ্ধ রামবাবু এক হাতে হুঁকা এবং অপর হাতে একখানি নীলরঙের চিঠি লইয়া উপস্থিত হইলেন।

অচলা রেলিং-এর পার্শ্বে বেতের সোফার উপর অর্ধশায়িতভাবে পড়িয়া একখানা বাংলা মাসিকের বিজ্ঞাপন পড়িতেছিল, জ্যাঠামশাইকে দেখিয়া উঠিয়া বসিল। রামবাবু চিঠিখানা অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিলেন, এই নাও সুরমা, তোমার রাক্ষুসীর পত্র। সে এতদিন তোমাকে লিখতে পারেনি ব’লে আমার চিঠির মধ্যেই যেমন অসংখ্য মাপ চেয়েছে, তেমনি অসংখ্য প্রণামও করেচে। তাকে তুমি মার্জনা কর। বলিয়া তিনি হাসিমুখে কাগজটুকু তাহার হাতে দিয়া অদূরে একখানি চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিলেন এবং নদীর দিকে চাহিয়া একমনে হুঁকা টানিয়া টানিয়া ধূঁয়ায় অন্ধকার করিয়া তুলিলেন।

অচলা পত্রখানি আদ্যোপান্ত বার-দুই পাঠ করিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল, কহিল, এঁরা সকলেই তা হলে পরশু সকালের গাড়িতে এসে পড়বেন? পিসীমা কে, জ্যাঠামশাই? আর তাঁর রাজপুত্রবধূ, রাজপুত্র, গার্‌জেন টিউটার—

রামবাবু হাসিয়া কহিলেন, রাক্ষুসী বেটী তামাশা করার একটা সুযোগ পেলে ত আর ছাড়বে না। পিসীমা হলেন আমার বিধবা ছোট ভগিনী আর রাজপুত্রবধূ হলেন তাঁর মেয়ে—ভাঁড়ারপুরের ভবানী চৌধুরীর স্ত্রী—তা সে যাই বলুক, রাজা-রাজড়ার ঘরই সে বটে। রাজপুত্র হলো তার বছর-দশেকের ছেলে—আর শেষ ব্যক্তিটি যে কি, তা ত চোখে না দেখলে বলতে পারিনে মা। হবেন কোন বেশি মাইনের চাকর-বাকর। বড়লোকের ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, এটা-ওটা-সেটা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যুগিয়ে দিয়ে সাবালক-নাবালক উভয় পক্ষের মান রাখেন—এমনি কিছু একটা হবেন বোধ করি। কিন্তু সেজন্যে ত ভাবচিনে সুরমা, আসুন, খান-দান, পশ্চিমের জল-হাওয়ায় গলাজ্বালা, বুকজ্বালা, দু’দিন স্থগিত হয় ত খুব খুশীই হবো; কিন্তু চিন্তা এই যে, বাড়িটি ত আমার ছোট, রাজা-রাজড়ার কথা ভেবে তৈরিও করিনি, ঘরদোরের বন্দোবস্তও তার উপযোগী নয়। সঙ্গে দাস-দাসীও আসবে হয়ত প্রয়োজনের তিনগুণ বেশি। আমি তাই মনে করচি, তোমার বাড়িটাকে যদি—

অচলা ব্যগ্র হইয়া বলিল, কিন্তু তার ত আর সময় নেই জ্যাঠামশাই, তা ছাড়া একলা অত দূরে থাকি কি তাঁদের সুবিধে হবে?

রামবাবু কহিলেন, সময় আছে, যদি এখন থেকেই লাগা যায়। আর জায়গা প্রস্তুত থাকলে কোথায় কার সুবিধে হবে, সে মীমাংসা সহজেই হতে পারবে। সুরেশবাবু ত শোনামাত্রই টমটম ভাড়া করে চলে গেছেন—তোমার গাড়িও তৈরি হয়ে এলো বলে; তুমি নিজে যদি একটু শীঘ্র প্রস্তুত হয়ে নিতে পারো মা, আমিও তা হলে সে ফুরসতে জুতোজোড়াটা বদলে একখানা উড়ুনি কাঁধে ফেলে নিই। তোমার ঘর-সংসারের বিলিব্যবস্থা ত সত্যি সত্যি আমরা পেরে উঠবো না।

অচলা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কহিল, আচ্ছা, আমি কাপড়টা বদলে নিচ্ছি, বলিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

রামবাবুর প্রস্তাব অসঙ্গত নয়, অস্পষ্টও নয়। আত্মীয় রাজকুমার ও রাজমাতার স্থান-সঙ্কুলান করিতে এ আশ্রয় ত্যাগ করিয়া যে এবার তাহাকে স্থানান্তরে যাইতে হইবে, এ কথা অচলা সহজেই বুঝিল; কিন্তু বুঝা সহজ হইলেই কিছু তাহার ভার লঘু হইয়া ওঠে না। মনের মধ্যে সেটা যতদূর গেল, ততদূর গুরুভার স্টিল রোলারের ন্যায় যেন পিষিয়া দিয়া গেল।

এতদিনের মধ্যে একটা দিনের জন্যেও কেহ তাহাকে বাটীর বাহির করিতে সম্মত করিতে পারে নাই। মিনিট-পনেরো পরে আজ প্রথম যখন সে নিজের অভ্যস্ত সাজে প্রস্তুত হইয়া শুধু এইজন্যই নামিয়া আসিল, তখন চারিদিকের সমস্তই তাহার চক্ষে নূতন এবং আশ্চর্য বলিয়া ঠেকিল, এমন কি আপনাকে আপনিই যেন আর-একরকম বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। ফটকের বাহিরে দাঁড়াইয়া প্রকাণ্ড জুড়ি; নব-পরিচ্ছেদে সজ্জিত কোচম্যান মনিব জানিয়া উপর হইতে সেলাম করিল; সহিস দ্বার খুলিয়া সসম্মানে সরিয়া দাঁড়াইল, এবং তাহাকেই অনুসরণ করিয়া বৃদ্ধ রামবাবু যখন সম্মুখের আসন গ্রহণ করিয়া বসিলেন তখন সমস্তটাই অদ্ভুত স্বপ্নের মত মনে হইতে লাগিল। তাহার আচ্ছন্ন দৃষ্টি গাড়ির যে অংশটার প্রতিই দৃষ্টিপাত করিল, তাহাই বোধ হইল, এ কেবল বহুমূল্য নয়, এ শুধু ধনবানের অর্থের দম্ভ নয়, ইহার প্রতি বিন্দুটি যেন কাহার সীমাহীন প্রেম দিয়া গড়া।

কঠিন পাথরের রাস্তার উপর চারজোড়া খুরের প্রতিধ্বনি তুলিয়া জুড়ি ছুটিল, কিন্তু অচলার কানের মধ্যে তাহা শুধু অস্পষ্ট হইয়া প্রবেশ করিল। তাহার সমস্ত অন্তর ও বহিরিন্দ্রিয় হয়ত শেষ পর্যন্ত এমন অভিভূত হইয়াই থাকিত, কিন্তু সহসা রামবাবুর কণ্ঠস্বরে সে চকিত হইয়া উঠিল। তিনি সম্মুখের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিলেন, মা, ওই তোমার বাড়ি দেখা যায়। লোকজন দাসদাসী সবই নিযুক্ত করা হয়ে গেছে, মোটামুটি সাজানো-গোছানোর কাজও বোধ করি এতক্ষণে অনেক এগিয়ে এলো, শুধু তোমাদের শোবার ঘরটিতে মা, আমি কাউকে হাত দিতে মানা করে দিয়েছি। তাঁর যাবার সময় বলে দিলাম, সুরেশবাবু, বাড়ির আর যেখানে যা খুশি করুন গে, আমি গ্রাহ্য করিনে, শুধু মায়ের ঘরটিতে কাজ করে মায়ের আমার কাজ বাড়িয়ে দেবেন না। এই বলিয়া বৃদ্ধ একখানি সলজ্জ হাসিমুখের আশায় চোখ তুলিয়াই একেবারে চুপ করিয়া গেলেন।

তিনি কেন যে এমন করিয়া থামিয়া গেলেন, অচলা তাহা সেই মুহূর্তেই বুঝিল, তাই যতক্ষণ না গাড়ি নূতন বাংলোর দরজায় আসিয়া পৌঁছিল, ততক্ষণ সে তাহার শুষ্ক বিবর্ণ মুখখানা বাহিরের দিকে ফিরাইয়া এই বৃদ্ধের বিস্মিত দৃষ্টি হইতে গোপন করিয়া রাখিল।

35 Shares