গৃহদাহ

স্নানান্তে জলে দাঁড়াইয়া গঙ্গাস্তোত্র আবৃত্তি করার মাঝে মাঝেও মেয়েটার সেই লুকাইবার চেষ্টাকে শাক দিয়া মাছ ঢাকার সঙ্গে তুলনা করিয়া বুড়োর ভারী হাসি পাইতে লাগিল এবং অন্তরের মধ্যে যে ক্ষোভ গতরাত্রি হইতে নিরন্তর বাড়িয়াই চলিয়াছিল, তাহা সন্ধ্যাহ্নিক সারিয়া ফিরিবার পথেই কল্পনার স্নিগ্ধ বর্ষণে জুড়াইয়া জল হইয়া গেল।

কাল সকালেই সকলে পৌঁছিবেন, তার আসিয়াছে। সঙ্গে রাজকুমার নাতি এবং রাজবধূ ভাগিনেয়ীর সংস্রবে সম্ভবতঃ লোকজন কিছু বেশি আসিবে। আজ তাঁহার বাটিতে কাজ কম ছিল না। উপরন্তু আকাশের গতিকও ভাল ছিল না। কিন্তু পাছে জল আসিয়া পড়ে, পাছে যাওয়ার বিঘ্ন ঘটে, এই ভয়ে রামবাবু বেলা পড়িতে না পড়িতে এক্কা ভাড়া করিয়া, বকশিশের আশা দিয়া দ্রুত হাঁকাইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু পথেই জলো হাওয়ার সাক্ষাৎ মিলিল এবং এ বাটীতে আসিয়া যখন উপস্থিত হইলেন, তখন কিছু কিছু বর্ষণও শুরু হইয়াছে।

অচলা বাহির হইয়া কহিল, এই দুর্যোগের মধ্যে আজ আবার কেন এলেন জ্যাঠামশাই? আর একটু হলেই ত ভিজে যেতেন।

তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে ভাবী আনন্দের চিহ্নমাত্র না দেখিয়া বুড়ার মন দমিয়া গেল। এজন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না—কে যেন তাঁহার কল্পনার মালাটাকে একটানে ছিঁড়িয়া দিল। তথাপি মুখের উৎসাহ বজায় রাখিয়া কহিলেন, ওরে বাস রে, তা হলে কি আর রক্ষা ছিল, জলে ভেজাটাকে সামলাতে পারব, কিন্তু ত্যাজ্যপুত্র হয়ে চিরটা কাল কে থাকবে মা?

এই দুর্বোধ মেয়েটাকে বুড়া কোনদিনই বেশ ভাল করিয়া চিনিতে পারেন নাই। বিশেষতঃ কাল রাত্রির ব্যবহারে ত বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার আজিকার আচরণে যেন একবারে দিশাহারা, আত্মহারা হইয়া গেলেন। সে যে কোনকালে, কোন কারণেই ওরূপ করিতে পারে, তেমন স্বপ্ন দেখাও যেন অসম্ভব। কথা ত মাত্র এইটুকু। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা ঠিক পাগল হইয়া গিয়া একেবারে ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার বুকের উপর উপুড় হইয়া হুহু স্বরে কাঁদিয়া উঠিল। বলিল, জ্যাঠামশাই, কেন আমাকে আপনি এত ভালবাসেন—আমি যে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছি।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধ কোন কথা কহিতে পারিলেন না, শুধু এক হাতে তাহাকে বুকের উপর চাপিয়া রাখিয়া অন্য হাতে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। তাঁহার স্নেহার্দ্র চিত্ত সেই-সব সামাজিক অনুমোদিত বিবাহের কথা, আত্মীয়স্বজন, হয়ত-বা বাপ-মায়ের সহিত বিদ্রোহ-বিচ্ছেদের কথা, বিবাদ করিয়া গৃহত্যাগের কথা—এই-সকল পুরাতন, পরিচিত ও বহুবারের অভ্যস্ত ধারা ধরিয়াই যাইতে লাগিল, কিন্তু কিছুতেই আর একটা নূতন খাদ খনন করিবার কল্পনামাত্র করিল না। এমনি করিয়া এই নির্বাক্‌ বৃদ্ধ ও রোরুদ্যমানা তরুণী বহুক্ষণ একভাবেই দাঁড়াইয়া রহিলেন। তার পরে চুপি চুপি বলিতে লাগিলেন, এতে আর লজ্জা কি মা! তুমি আমার মেয়ে, তুমি আমার সেই সতীলক্ষ্মী মা, অনেককাল আগে কেবল দু’দিনের জন্য আমার কোলে এসেই চলে গিয়েছিলে—মায়া কাটাতে না পেরে আবার বাপের বুকে ফিরে এসেছ—আমি যে তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলাম সুরমা! বলিয়া তাহাকে নিকটবর্তী একটা চেয়ারে বসাইয়া নানারকমে পুনঃ পুনঃ এই কথাটাই বুঝাইতে লাগিলেন যে, ইহাতে কোন লজ্জা, কোন শরম নাই। যুগে যুগে চিরদিনই ইহা হইয়া আসিতেছে। যিনি সতী, যিনি স্বয়ং আদ্যাশক্তি, তিনিও একবার স্বামীর ঘর করিতে বাপ-মা আত্মীয়-স্বজন সকলের সঙ্গেই ঝগড়া করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। আবার সব হইবে, সব ফিরিয়া পাইবে, আজ যাহারা বিমুখ, আবার তাহারা মুখ ফিরাইবে, আবার তাহাদের পুত্র-পুত্রবধূকে যত্নে তুলিয়া লইবে। দেখ দেখি মা, আমার এ আশীর্বাদ কখনো নিষ্ফল হইবে না।

এমনি কত-কি বৃদ্ধ মনের আবেগে বকিয়া যাইতে লাগিলেন। তাহাতে সার যাহা ছিল, তাহা থাক, কিন্তু তাহার ভারে যেন শ্রোতাটির আনত মাথাটি ধীরে ধীরে ধূলির সঙ্গে মিশিয়া যাইবার উপক্রম করিতে লাগিল। চাপিয়া বৃষ্টি আসিয়াছিল। এমনি সময়ে দেখিতে পাওয়া গেল, সুরেশ ভিজিয়া কাদা মাখিয়া কোথা হইতে হনহন করিয়া বাড়ি ঢুকিতেছে। দেখিবামাত্রই অচলা তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া ফেলিল এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া বৃষ্টির জল হাত বাড়াইয়া লইয়া অশ্রুজলের সমস্ত চিহ্ন ধুইয়া ফেলিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল। রামবাবু বুঝিলেন, সুরমা যে-জন্যই হোক, চোখের জলের ইতিহাসটা স্বামীর কাছে গোপন রাখিতে চায়।

সে উপরে উঠিয়া রামবাবুকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই তিনি ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, কথাবার্তা পরে হবে সুরেশবাবু, আমি পালাই নি। আপনি কাপড় ছেড়ে আসুন।

সুরেশ হাসিয়া কহিল, এ কিছুই না। বলিয়া একটা চৌকি টানিয়া বসিবার উদ্যোগ করিতেছিল, অচলা মুখ তুলিয়া চাহিল,—জ্যাঠামশায়ের কথাটা শুনতে দোষ কি? এক মাস হয়নি তুমি অতবড় অসুখ থেকে উঠেছ—বার বার আমাকে আর কত শাস্তি দিতে চাও?

তাহার বাক্য ও চাহনির মধ্যে এত বড় ব্যবধান ছিল যে, দুজনেই বিস্মিত হইলেন, কিন্তু এই বিস্ময়ের স্রোতটা বহিতে লাগিল ঠিক বিপরীত মুখে। সুরেশ কোন জবাব না দিয়া নীরবে আদেশ পালন করিতে চলিয়া গেল, আর রামবাবু বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন।

সেই বাহিরের বারিপাতের আর বিরাম নাই; রাত্রি যত বাড়িতে লাগিল, বৃষ্টির প্রকোপ যেন ততই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। বহুদিনের আকর্ষণে ধরিত্রী শুষ্কপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিল, মনে হইতে লাগিল, তাহার সমস্ত দীনতা, সমস্ত অভাব আজিকার এই রাত্রির মধ্যেই পরিপূর্ণ করিয়া দিতে বিধাতা বদ্ধপরিকর হইয়াছেন।

রামবাবুর উদ্বেগ লক্ষ্য করিয়া অচলা আস্তে আস্তে বলিল, ফিরে যেতে বড় কষ্ট হবে জ্যাঠামশাই, আজ রাত্তিরেই কি না গেলে নয়?

35 Shares