গৃহদাহ

তিনি হাসিলেন, মানসিক চাঞ্চল্য দমন করিয়া কহিলেন, কষ্টের জন্য না হোক, এই দুর্যোগে এই নূতন জায়গায় তোমাদের ছেড়ে আমি যেতাম না। কিন্তু কাল সকালেই যে ওঁরা সব আসবেন, রাত্রির মধ্যেই আমার ত ফিরে না গেলেই নয় সুরমা। কিন্তু মনে হচ্ছে, এ-রকম থাকবে না, ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই কমে আসবে। আমি এই সময়টুকু অপেক্ষা করে দেখি।

এই প্রসঙ্গে কাল যাঁহারা আসিতেছেন, তাঁহাদের কথা হইতে আরম্ভ করিয়া আলোচনা সংসারের দিকে, সমাজের দিকে, ধর্মাধর্ম পাপপুণ্য ইহলোক পরলোক কত দিকেই না ধীরে ধীরে ছড়াইয়া পড়িল। উভয়ে এমনি মগ্ন হইয়া রহিলেন যে, সময় কতক্ষণ কাটিল, রাত্রি কত হইল, কাহারও চোখেও পড়িল না। বাহিরে গর্জন ও বর্ষণ উত্তরোত্তর কিরূপ নিবিড়, অন্ধকার কত দুর্ভেদ্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহাও কেহ দৃষ্টিপাত করিল না; এই বৃদ্ধের মধ্যে যে জ্ঞান, যে ভূয়োদর্শন, যে ভক্তি সঞ্চিত ছিল, তাঁহার পরম স্নেহের পাত্রীটির কাছে তাহা অবাধে উৎসারিত হইতে পাইয়া এই কেবলমাত্র দুটি লোকের নিরালা সভাটিকে যেন মাধুর্যমণ্ডিত করিয়া দিল। অচলার শুধু এই চেতনাটুকু অবশিষ্ট রহিল যে, সে এমন একটি লোকের হৃদয়ের সত্য অনুভূতির খবর পাইতেছে, যিনি নিষ্পাপ, যাঁহার স্নেহ, প্রীতি ও শ্রদ্ধা সে একান্তভাবেই লাভ করিয়াছে।

হঠাৎ পদশব্দে চকিত হইয়া উভয়েই পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলেন, ভৃত্য দাঁড়াইয়া আছে। সে কহিল, মা, রাত অনেক হয়েছে, প্রায় বারোটা বাজে—আপনার খাবার কি দিয়ে যাবে?

অচলা চমকিয়া কহিল, বারোটা বাজে? বাবু?

তিনি এইমাত্র খেয়ে শুতে গেছেন।

সে যে সেই গিয়াছে, আর আসে নাই, ইহা শুধু এখনই চোখে পড়িল। অচলা মুখ বাড়াইয়া দেখিল, শোবার ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়া আলো দেখা যাইতেছে। রামবাবু ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত হইয়া বার বার বলিতে লাগিলেন, আমার বড় অন্যায় হয়ে গেছে মা, বড় অন্যায় হয়েছে। তোমাকে এমন ধরে রাখলাম যে, তাঁর খাওয়া হল কি না, তুমি চোখে দেখতেও পেলে না। এখন যাও মা তুমি খেতে—

অচলা এ-সকল কথায় বোধ হয় কোন কান দিল না। ভৃত্যকে প্রশ্ন করিল, কোচম্যান গাড়ি জুতে ঠিক সময়ে আনেনি কেন?

ভৃত্য কহিল, নূতন ঘোড়া, এই ঝড়-জল-অন্ধকারে বার করতে তার সাহস হয় না।

তা হলে আর কোন গাড়ি আনা হয়নি কেন?

ভৃত্য চুপ করিয়া রহিল। কিন্তু তাহার অর্থ অপরাধ স্বীকার করা নয়, বরঞ্চ প্রতিবাদ করা যে, এ হুকুম ত তাহারা পায় নাই।

রামবাবু উৎকণ্ঠার পরিবর্তে লজ্জা পাইয়াই ক্রমাগত বলিতে লাগিলেন, গাড়ির আবশ্যক নেই—না গেলেও ক্ষতি নেই—কেবল প্রত্যুষে স্টেশনে গিয়ে হাজির হতে পারলেই চলবে। আমি রাত্রে কিছুই খাইনে, আমার সে ঝঞ্ঝাটও নেই—শুধু তুমি দুটি খেয়ে নিয়ে শুতে যাও মা, কথায় কথায় বড্ড রাত হয়ে গেছে—বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে। এই বলিয়া একরকম জোর করিয়াই তাহাকে নীচে যাইবার জন্য পাঠাইয়া দিলেন এবং মিনিট-পনের পরে সে উপরে আসিতে, ব্যগ্র ও উৎসুক হইয়া বলিতে লাগিলেন, আর এক মিনিট দেরি নয় মা, তুমি শুতে যাও। আমি এই বসবার ঘরের কোচখানার উপর দিব্যি শুতে পারব, আমার কোন কষ্ট, কোন অসুবিধা হবে না—শুধু তুমি শুতে যাও সুরমা, আমি দেখি।

বৃদ্ধের সনির্বন্ধ আবেদন ও নিবেদন এবং পুনঃ পুনঃ উত্তেজনা অচলাকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল। যে মিথ্যা সম্মান, প্রীতি ও শ্রদ্ধা সে তাহার এই নিত্য শুভাকাঙ্ক্ষী পিতৃব্যসম বৃদ্ধের নিকট হইতে এতকাল শুধু প্রতারণার দ্বারাই পাইয়া আসিয়াছে, সে লোভেই এই তাহার একান্ত দুঃসময়ে কণ্ঠরোধ করিয়া অপ্রতিহত বলে সুরেশের নির্জন শয়নমন্দিরের দিকে ঠেলিতে লাগিল। তাহার মনে পড়িল, এমনি এক ঝড়-জল-দুর্দিনের রাত্রিই একদিন তাহাকে স্বামিহারা করিয়াছিল, আজ আবার তেমনি এক দুর্দিনের দুরতিক্রম্য অভিশাপ তাহাকে চিরদিনের মত সীমাহীন অন্ধকারে ডুবাইতে উদ্যত হইয়াছে। কাল অসহ্য অপমানে, লজ্জার গভীরতর পঙ্কে তাহার আকণ্ঠ মগ্ন হইয়া যাইবে, ইহা সে চোখের উপর স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, কিন্তু তবুও আজিকার মত ওই মিথ্যাটাই জয়মাল্য পরিয়া তাহাকে কোনমতেই সত্য প্রকাশ করিতে দিল না। আজ জীবনের এই চরম মুহূর্তে অভিমান ও মোহই তাহার চিরজয়ী হইয়া রহিল। সে বাধা দিল না, কথা কহিল না, একবার পিছনে চাহিয়াও দেখিল না—নিঃশব্দে ধীরে ধীরে সুরেশের শয়ন-কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল।

বাহিরের মত্ত প্রকৃতি তেমনি মাতলামি করিতে লাগিল, প্রগাঢ় অন্ধকারে বিদ্যুৎ তেমনি হাসিয়া হাসিয়া উঠিতে লাগিল, সারারাত্রির মধ্যে কোথাও তাহার লেশমাত্র ব্যতিক্রম হইল না।

নূতন স্থানে রামবাবুর সুনিদ্রা হয় নাই, বিশেষতঃ মনের মধ্যে চিন্তা থাকায় অতি প্রত্যুষেই তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, বৃষ্টি থামিয়াছে বটে কিন্তু ঘোর কাটে নাই। চাকরেরা কেহ উঠিয়াছে কিনা, দেখিবার জন্য বারান্দার একপ্রান্তে আসিয়া হঠাৎ চমকিয়া গেলেন। কে যেন টেবিলে মাথা পাতিয়া চেয়ারে বসিয়া আছে। কাছে আসিয়া বিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, সুরমা, তুমি যে? এত ভোরে উঠেছ কেন মা?

সুরমা একবারমাত্র মুখ তুলিয়াই আবার তেমনি করিয়া টেবিলের উপর মাথা রাখিল। তাহার মুখ মড়ার মত সাদা, দুই চোখের কোলে গাঢ় কালিমা এবং কালো পাথরের গা দিয়া যেমন ঝরনার ধারা নামিয়া আসে, ঠিক তেমনি দুই চোখের কোল বাহিয়া অশ্রু ঝরিতেছে।

বৃদ্ধ শুধু একটা অস্ফুট শব্দ করিয়া একদৃষ্টে ওই অর্ধমৃত নারীদেহের প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন, কোন কথাই তাঁহার কণ্ঠ ভেদিয়া বাহির হইতে পারিল না।

35 Shares