গৃহদাহ

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ কোন কথা কহিলেন না, নিঃশব্দে ম্লানমুখে তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। তার পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, আমিও তোমাকে আজ বলে রাখছি মা, এই কাজটিই তোমাকে কিছুতে করতে দেব না। তুমি আমার চোখের মণি, তুমি আমার মা, তুমি আমার একমাত্র আশ্রয়। এই অনাথ অকর্মণ্য বুড়োটার ভার থেকে ছুটি নেবার দিন যেদিন তোমার আসবে মা, সে হয়ত বেশি দূরে নয়, কিন্তু সে আমাকে চোখে দেখতে হবে না, তাও আমি বেশ জানি। বলিতে বলিতেই তাঁহার চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল।

জামার হাতায় মুছিয়া ফেলিয়া কহিলেন, আমার একটা কাজ এখনো বাকী রয়েচে, সেটা মহিমের সঙ্গে দেখা করা। কেন সে পালিয়ে বেড়াচ্চে, একবার স্পষ্ট করে তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। এমনও ত হতে পারে, সে বেঁচে নেই?

কেন বাবা, তুমি ও-সব ভয় করচ?

ভয়? বৃদ্ধের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল, কহিলেন, সন্তানের মরণটাই বাপের কাছে সবচেয়ে বড় নয় মা!

ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

একমাত্র কন্যার মৃত্যুর চেয়েও যে দুর্গতি পিতার চক্ষে বড় হইয়া উঠিয়াছে, তাহার আভাসমাত্রেই মৃণাল কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হইয়া যখন নিঃশব্দে সরিয়া গেল, তখন এই সাধ্বী বিধবা মেয়েটির লজ্জাটা যেন ঠিক একটা মুগুরের মত কেদারবাবুর বুকে আসিয়া পড়িল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত একাকী চুপ করিয়া নিজের পাকা দাড়িতে হাত বুলাইলেন, তার পরে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া ধীরে ধীরে তেলের বাটিটা টানিয়া লইলেন।

আজ সকালবেলাটা বেশ পরিষ্কার ছিল, কিন্তু মধ্যাহ্নের কিছু পর হইতেই মেঘলা করিয়া আসিতে লাগিল। কেদারবাবু এই মাত্র শয্যায় উঠিয়া বসিয়া পশ্চিমের জানালাটা খুলিয়া দিয়া বাহিরে চাহিয়াছিলেন, সম্মুখে একটা পুষ্পিত পেয়ারাগাছ ফুলে ফুলে একবারে ছাইয়া গিয়াছে এবং তাহার উপরে অসংখ্য মৌমাছির আনন্দ-কলরবের আর অন্ত নাই। অদূরে লম্বা দড়িতে বাঁধা মৃণালের স্বহস্ত-পরিমার্জিত চিকন পরিপুষ্ট গাভীটি বড় বড় নিশ্বাস ফেলিয়া চরিয়া ফিরিতেছে এবং তাহার পিঠের উপর দিয়া পল্লীপথের কতকটা অংশ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে।

বাবা, তোমার চা-টা এইবার নিয়ে আসি গে?

কেদারবাবু ফিরিয়া চাহিয়া কহিলেন, এর মধ্যে নিয়ে আসবে মা।

বাঃ—বেলা বুঝি আর আছে?

তিনি একটু হাসিয়া বালিশের তলা হইতে ঘড়িটি বাহির করিয়া বলিলেন, কিন্তু এখনো যে তিনটে বাজেনি মা!

মৃণাল কহিল, নাই বাজলো বাবা তিনটে; ও-বেলা যে তোমার মোটেই খাওয়া হয়নি।

কেদারবাবু মনে মনে বুঝিলেন, আপত্তি নিষ্ফল। তাই বলিলেন, আচ্ছা আনো। মৃনাল মুহূর্তকাল স্থির থাকিয়া কহিল, আচ্ছা বাবা, তুমি যে বড় বল, তুমি গরম চিঁড়ে বড্ড ভালবাসো?

কথাটা ত মিছে বলিনে মা!

তবে, তাও দুটি আনি?

তাও আনবে? আচ্ছা আনো গে, বলিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া জোর করিয়া একটু হাসিলেন। মৃণাল চলিয়া গেলে আবার সেই জানালাটার বাহিরে দৃষ্টিপাত করিতে গিয়াই দেখিলেন, সমস্ত ঝাপসা অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে; পরক্ষণেই পাঁচ-ছয় ফোঁটা তপ্ত অশ্রু টপটপ করিয়া তাঁহার কোলের উপর ঝরিয়া পড়িল। ব্যস্ত হইয়া জামার হাতায় বৃদ্ধ জলের রেখাদুটি মুছিয়া ফেলিয়া মুখখানি শান্ত এবং সহজ দেখাইবার চেষ্টায় এমার্সনের খোলা বইটা চোখের সুমুখে তাড়াতাড়ি মেলিয়া ধরিলেন।

তাহার পাতার ভিতরে যাই থাক, মনের মধ্যে এই কথাটারই ছাপ পড়িতে লাগিল, এ কি আশ্চর্য অজ্ঞেয় ব্যাপার এই সৃষ্টিটা! সংসারের দিনগুলা যখন গণনার মধ্যে আসিয়া ঠেকিল, তখনই কি এই দীর্ঘজীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, সকল আয়োজন বাতিল করিয়া আবার নূতন করিয়া অর্জন করিবার প্রয়োজন পড়িল; বেশ দেখিতেছি, আমার মানবজন্মের সমস্ত অতীতটাই একপ্রকার ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে—অথচ এ কথা বুঝিতেও ত বাকী নাই, এই সুদীর্ঘ ফাঁকি ভরিয়া তুলিতে এই একটা মাসই যথেষ্ট হইল।

দ্বারে পদশব্দ শুনিয়া তিনি মুখ তুলিয়া চাহিলেন। মৃণাল পাথর-বাটিতে চা এবং রেকাবিতে চিঁড়ে-ভাজা লইয়া প্রবেশ করিল। দুই হাত বাড়াইয়া সেগুলি গ্রহণ করিতে করিতে কহিলেন, আজ খাওয়া যে আমার ভাল হয়নি তা এখন টের পাচ্ছি। কিন্তু দেখ মা—

না বাবা, তুমি কথা কইতে শুরু করলে সব জুড়িয়ে যাবে।

কেদারবাবু নীরবে চায়ের বাটিটা মুখে তুলিয়া দিলেন এবং শেষ হইলে নামাইয়া রাখিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, আমি এই কামনাই কেবল করি মৃণাল, তুমি আসচে-বারে যেন আমার মেয়ে হয়ে জন্মাও। বুকে করে মানুষ করার বিদ্যেটা আমার খুব শেখা আছে মা, সেইটে যেন সেবার সারাজীবন ভরে খাটাবার অবসর পাই।

শেষ দিকটায় তাঁহার কণ্ঠস্বর কাঁপিতে লাগিল, কিন্তু এই ধরনের আলোচনাকেই মৃণাল সবচেয়ে ভয় করিত। তাই তাঁহার অপরিস্ফুট আবেগের প্রতি লক্ষ্যমাত্র না করিয়াই সহাস্যে কহিল, বা, বেশ ত বাবা, তোমার অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে আমিও যেন একজন হই।

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, না, অনেক নয় মা, অনেক নয়। কেবল তুমি একা—আমার একটি মেয়ে। একলা তুমি আমার সমস্ত বুক জুড়ে থাকবে। এবার যা কিছু তোমার কাছে শিখে যাচ্ছি, সেগুলি আবার একটি একটি করে আমার মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে আবার ঠিক এমনি করে বুড়ো-বয়সে সমস্তটুকু তার কাছ থেকে ফিরে নিয়ে পরজন্মের পথে যাত্রা করব। বলিয়াই তিনি অলক্ষ্যে একবার চোখের কোণে হাত দিয়া লইলেন।

মৃণাল ক্ষুণ্ণকণ্ঠে কহিল, তুমি কেবল আমাকে অপ্রতিভ কর বাবা। আমি কি জানি বল ত?

এই যে মা আমার খাওয়া হয়নি, আমি নিজে জানলাম না, কিন্তু তুমি জানতে।

ও ত ভারী জানা! যার চোখ আছে, সেই ত দেখতে পায়।

কিন্তু ওই চোখটাই যে সকলের থাকে না মৃণাল! বলিয়া একটুখানি থামিয়া কহিলেন, আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেছি এই দেখে মা, ভগবান কোথায়, কবে আর কি উপায়ে যে মানুষের যথার্থ আপনার জনটিকে মিলিয়ে দেন, তা কেউ জানে না! এর না আছে আড়ম্বর, না আছে কোন সম্পর্কের বালাই, না আছে সময়ের হিসাব। নিমিষে কোথা দিয়ে কি হয়ে যায়—কেবল বুক ভরে যখন তাকে পাই, তখনই মনে হয়, এতকাল এতবড় ফাঁকাটা সয়েছিলুম কেমন করে?

35 Shares