গৃহদাহ

অচলার মুখের উপর দিয়া একটা সলজ্জ স্নিগ্ধ হাসি খেলিয়া গেল। কহিল, আপনার এখনও কেউ হয়নি বলেই এ কথা বললেন ; কিন্তু হলে ঠিক ওঁর মতই অবহেলা করে চলে যেতেন—এ আমি নিশ্চয় বলচি।

সুরেশ তাহার বসিবার চৌকির হাতলের উপর সজোরে একটা চপেটাঘাত করিয়া কহিল, কখ্‌খনো না। আমাকে আপনি চেনেন না, তাই এ কথা বলতে পারলেন; কিন্তু চিনলে পারতেন না।

অচলা কহিল, বেশ ত, এখন থেকে ত চিনতে পারব, আর কেউ হলে জানতেও পারব। কি বলেন?

সুরেশ কহিল, নিশ্চয়। এক শ’বার। তা ছাড়া মহিমের মত আমি বন্ধুর কাছে কোন কথা গোপন করে রাখতেও পারিনে, রাখা ভালও মনে করিনে; বলিয়া হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি বলচেন, হলে জানতে পারবেন, কিন্তু আমি বলচি যে, আপনাকে না জানিয়ে, আপনার মত না নিয়ে এ-সব কখনো হবেই না; কারণ আপনাকে মহিমের সঙ্গে পৃথক করে দেখবার সাধ্য আর আমার নেই। আপনারা আমার কাছে আজ অভিন্ন।

অচলা সলজ্জ হাসিমুখে মাথা নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা, সে তখন দেখা যাবে। কিন্তু আপনাকে যাচাই করার শুভদিন না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু আপনার বন্ধুকে দোষী করতে পারব না সুরেশবাবু।

সুরেশ সহসা গম্ভীর হইয়া কহিল, সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমাকে যাচাই করবার শুভদিন এ জন্মে ঘটবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু সে যাক। আজ সকালেই কেন আপনাদের কাছে এসেছি জানেন? কাল রাত্রে আমি ঘুমুতে পারিনি—না এলে আজও পারব না তাও জানতুম। আমি অনেক অপরাধ করেছি—তার সমস্ত একটি একটি করে আজ আপনার কাছে স্বীকার করে আমি যাব। আমি তাই এসেছি।

তাহার প্রবল বিরুদ্ধতা অচলার অবিদিত ছিল না। তাই সে শঙ্কিত-মুখে চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। সুরেশ বলিতে লাগিল, কাল সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি মহিম বসে আছে। ভাল কথা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন—আমি ব্রাহ্মদের দু’চক্ষে—অর্থাৎ কিনা, ব্রাহ্মসমাজটাকে আমি তেমন ভাল মনে করিনে।

অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ, আমি জানি।

সুরেশ বলিতে লাগিল, জানবেন বৈ কি। কিন্তু এ কথাটাও ভুলবেন না যে, আমি তখন আপনাকে চিনতুম না। তাই মহিমকে অনুরোধ করি, সে যেন অন্তত: একটা মাস এখানে না আসে। কেন জানেন?

অচলা পুনরায় মাথা নাড়িয়া বলিল, না। তবে বোধ হয়, আপনি ভেবেছিলেন পুরুষমানুষের ভুলতে একটা মাসই যথেষ্ট সময়। তবে বেশি বিলম্ব হওয়া সঙ্গত নয়।

আঘাতটা সুরেশ বিনীতভাবে গ্রহণ করিয়া বলিল, আমি চিরদিনই নির্বোধ। হয়ত এমনই কিছু একটা মনে করে থাকব। তা ছাড়া আরও একটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র আপনার বিরুদ্ধে আমার ছিল। আমি শপথ করেছিলুম, এই একটা মাসের মধ্যেই আর কোথাও পাত্রী স্থির করে মহিমের বিয়ে দেব। যেমন করেই হোক তাকে আটকাতে হবে। আমার বন্ধু হয়ে সে যে একটা নারীর মোহে নিজেদের সমাজ ছেড়ে চলে যাবে, এ যেন কিছুতেই না ঘটতে পায়।

অচলা রুদ্ধ-নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, তার পরে?

তাহার পাংশু মুখের পানে চাহিয়া সুরেশ একটুখানি হাসিল; কহিল, তার পরে আর ভয় নেই। এ পাপ-সঙ্কল্প ত্যাগ করেছি, আজ সেই কথাই আমি স্বীকার করে যাব। আপনাকে দেখা দেবার জন্যে কাল রাত্রে তাকে অনেক অনুরোধ করেচি। একদিন আমার অনুরোধটা সে রেখেছিল, কিন্তু কালকের অনুরোধটা রাখলে না—আপনাকে দেখা না দিয়েই সে কলকাতা ছেড়ে চলে গেল।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, যাবার কোন কারণ দেখিয়েছিলেন?

সুরেশ কহিল, না। দরকার আছে—এই মাত্র।

অচলা আর একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া যেন আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল—দরকার! দরকার! চিরকাল তাঁর মুখে এই কথাই শুনে আসছি—চিরদিন প্রয়োজনই তাঁর সর্বস্ব!

সুরেশ কহিল, একটা চিঠি লিখেও ত সে আপনাকে জানাতে পারত।

অচলা ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিল, না। চিঠি তিনি লেখেন না।

সুরেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল; বলিল, কি প্রয়োজন, তাও কখনো বলে না। তার সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ সমস্তই তার একার। স্বার্থপর! কখনো কাউকে তার ভাগ দিলে না। এই নিয়ে কত দুঃখ সে যে ছেলেবেলা থেকে আমাকে দিয়ে এসেছে, বোধ করি, তার সীমা নেই। নিষ্ঠুর! দিনের পর দিন নিজে উপোস করে, আমার প্রতিদিনের খাওয়া-পরা তিক্ত বিষাক্ত করেচে—কিন্তু কখনো কোনদিন আমার মুখ চেয়েও আমার হাত থেকে কিছু নেয়নি। আমার ভয় হয়, যে পাষাণকে নিয়ে আমি কখনো সুখ পাইনি, তাকে নিয়ে আপনিই কি সুখী হতে পারবেন? বলিতে বলিতেই অকস্মাৎ তাহার চোখ-দুটো অশ্রুজলে ঝকঝক করিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিয়া, জোর করিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, দেখুন, আমার বাইরেটা ভারী শক্ত দেখতে, কিন্তু ভিতরটা তেমনি দুর্বল। মহিমের ঠিক তার উলটো—তবু আমাদের মত বন্ধুত্ব সংসারে বোধ করি খুব কমই ছিল।

অচলা নতমুখে মৃদুকণ্ঠে বলিল, সে আমি জানি সুরেশবাবু, এবং আরও জানি যে, সে বন্ধুত্ব আজও তেমনি অক্ষয় হয়ে আছে।

শৈশবের সমস্ত পূর্বস্মৃতি সুরেশের বুকের ভিতর আলোড়িত হইয়া উঠিল, সে অশ্রু-রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, যখন জানেনই, তখন এই ভিক্ষা আজ আমাকে দিন যে, অজ্ঞানে যে শত্রুতা আপনাদের করেচি, সে অপরাধ আর যেন আমার বুকে না বেঁধে।

তাহার কণ্ঠস্বর আবেগে পুনরায় রুদ্ধ হইয়া আসিল এবং এই একান্ত ব্যাকুলতায় অচলার নিজের অন্তরটাও যেন দুলিয়া দুলিয়া উঠিল। সে উদ্গত অশ্রু গোপন করিতে অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়াই দেখিল, তাহার পিতা দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

কেদারবাবু সুরেশকে দেখিয়া খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই যে সুরেশবাবু!

সুরেশ দাঁড়াইয়া নমস্কার করিল।

কেদারবাবু আসন গ্রহণ না করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, মহিমের খবর কি? তাকে ত দেখচি নে!

সুরেশ বলিল, মহিম অত্যন্ত প্রয়োজনে সকালের গাড়িতেই বাড়ি চলে গেল—এই খবর জানাবার জন্যেই আমি এলুম।

কেদারবাবু বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, বাড়ি চলে গেল। বলিয়াই সহসা জ্বলিয়া উঠিয়া কহিতে লাগিলেন, সে বাড়ি যাক, থাক, আমাদের তাতে আর কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তুমি বাবা সুরেশ যখন সময় পাবে বাড়ির ছেলের মত এখানে এসো, যেয়ো—আমার বড় আনন্দ হবে—কিন্তু তোমার সেই মিথ্যাচারী বন্ধুরত্নটি যেন আর কখন এ বাড়িতে মুখ না দেখায়। দেখা হলে বলে দিও তার আর কোন লজ্জা না থাকে—অন্ততঃ অপমানের ভয়টা যেন থাকে।

35 Shares