গৃহদাহ

কিন্তু বাবা, লোকে মৃত্যুর শোকও ত সহ্য করতে পারে!

কেদারবাবু বলিলেন, আমার পক্ষে সে মৃত, এই ত তুমি বলচ মা। এক হিসাবে তাই বটে। অনেকবার আমার মনেও হয়েছে—কিন্তু মৃত্যুর শোক যেমন বড়, তার শান্তি, তার মাধুর্য তেমনি বড়। কিন্তু সে সান্ত্বনার উপায় কৈ মৃণাল? এর দুঃসহ গ্লানি, অসহ্য লজ্জা আমার বুকের পথ জুড়ে এমনি বেধে আছে যে কোথাও তাদের নাড়িয়ে রাখবার এতটুকু ফাঁক নেই। বলিয়া চক্ষু মুদিয়া বুকের উপর হাতখানি পাতিয়া রাখিয়া আবার ধীরে ধীরে বলিলেন, মা, সন্তানের মৃত্যু যিনি দেন, তাঁকে আমরা এই বলে ক্ষমা করি যে, তাঁর কার্যকারণ আমরা জানিনে! আমরা—

মৃণাল হঠাৎ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, বাবা, আমরাও তা হলে তাই করতে পারি? যে কেউ হোক না, যার কার্যকারণ আমাদের জানা নেই, তাকে মাপ করতেই যদি না পারি, অন্ততঃ মনে মনে তার বিচার করে তাকে অপরাধী করে রাখব না।

বৃদ্ধ ঠিক যেন চমকিয়া উঠিলেন, এবং দুই চক্ষের তীব্র দৃষ্টি অপরের মুখের প্রতি একাগ্র করিয়া পাথরের মত নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিলেন।

মৃণাল সলজ্জমুখে আস্তে আস্তে বলিতে লাগিল, তা ছাড়া আমি সেজদার কাছেই শুনেচি বাবা, যে, সংসারে এমন অপরাধ অল্পই আছে ইচ্ছে করলে যাকে ক্ষমা করা না যায়।

কেদারবাবু উত্তেজনায় সোজা উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, এ অপরাধও কি কেউ কোনদিন মাপ করতে পারে মৃণাল?

মৃণাল চুপ করিয়া রহিল। তিনি তেমনি তীব্রস্বরে কহিতে লাগিলেন, কখনও নয়, কখনও নয়। বাপ হয়ে তার এ দুষ্কৃতি আমি কোনমতেই ক্ষমা করব না। ক্ষমার যোগ্য নয়, ক্ষমা করা উচিত নয়—এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলে দিলাম।

মৃণাল ধীরে ধীরে বলিল, যোগ্য-অযোগ্য ত বিচারের কথা বাবা, তাকে ক্ষমা বলা চলে না। তা ছাড়া ক্ষমার ফল কি শুধু অপরাধীই পায়, যে ক্ষমা করে, সে কি কিছুই পায় না বাবা?

বৃদ্ধ একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন। মেয়েটির এই শান্ত স্নিগ্ধ কথাগুলি একমুহূর্তেই তাঁহাকে যেন অভিভূত করিয়া ফেলিল। খানিকক্ষণ আচ্ছন্নের মত বসিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ বলিয়া উঠিলেন, এমন করে ত আমি ভেবে দেখিনি মৃণাল! তোমার কাছে আজ যেন আবার এক নূতন তত্ত্ব লাভ করলুম মা। ঠিক কথাই ত। যে গ্রহণ করে, লাভের খাতায় তাকে কি কেবল ষোল-আনা উসুল দিয়ে দাতার অঙ্কে শূন্য বসাতে হবে? এমন কিছুতেই সত্য হতে পারে না। ঠিক ঠিক! কার অপরাধ কত বড়, সে বিচার যার খুশি সে করুক, আমি ক্ষমা করব কেবল আমার পানে চেয়ে! এই না মা তোমার উপদেশ?

কেন বাবা, এই-সব বলে আমার অপরাধ বাড়াচ্চ?

তোমার অপরাধ? সংসারে তারও কি স্থান আছে মা?

মৃণাল হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ঐ বুঝি মা আমাকে আবার ডাকচেন—আমি এখুনি আসচি বাবা। বলিয়া সে দ্রুতবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

মৃণাল উঠিয়া গেল, কিন্তু কেদারবাবু সেদিকে আর যেন লক্ষ্যই করিলেন না। কেবল নিজের কথার সুরে মগ্ন থাকিয়া আপন মনে কহিতে লাগিলেন, আমি বাঁচিলাম! আমি বাঁচিলাম মা, আমাকে তুমি বাঁচাইয়া দিলে। দুর্গতির দুর্গম অরণ্যে যখন দু’চক্ষু বাঁধা, মৃত্যু ভিন্ন আর যখন আমার সমস্ত রুদ্ধ, তখন হাতের পাশেই যে মুক্তির এত বড় রাজপথ উন্মুক্ত ছিল, এ খবর তুমি ছাড়া আর কে দিতে পারিত! ক্ষমার কথা ত কখনো ভাবিতেই পারি নাই। যদি কখনো মনে হইয়াছে, তখনি তাহাকে দুই হাতে ঠেলিয়া দিয়া সজোরে, সগর্বে ইহাই বলিয়াছি, না, কদাচ না! মেয়ে হইয়া এত বড় অপরাধ যে করিতে পারিল, বাপ হইয়া এত বড় দান তাহাকে কোনমতেই দিতে পারি না। কিন্তু ওরে অন্ধ, ওরে মূঢ়, ওরে কৃপণ, পিতা হইয়া যাহা তুই দিতে পারিস না, অপরে তাহা দিবে কি করিয়া? আরে সে তোর কতটুকু বা লইয়া যাইবে? তোর ক্ষমার সবটুকু যে তোর আপন ঘরেই ফিরিয়া আসিবে। তোর মৃণাল-মায়ের এই তত্ত্বটাকে একবার দু’চক্ষু মেলিয়া দেখ্‌। বলিয়া তিনি ঠিক যেন কিছু একটা দেখিবার জন্যই দু’চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া মেঘলা আকাশের পানে চাহিয়া মনে মনে প্রাণপণ-বলে কহিতে লাগিলেন, আমি ক্ষমা করিলাম, আমি ক্ষমা করিলাম! সুরেশ, তোমাকে ক্ষমা করিলাম। অচলা, তোমাকেও ক্ষমা করিলাম! পশু-পক্ষী কীট-পতঙ্গ যে-কেহ যেখানে আছ, আমি সকলকে ক্ষমা করিলাম! আজ হইতে কাহারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিমান, কোন নালিশ নাই, আজ আমি মুক্ত, আজ আমি স্বাধীন, আজ আমি পরমানন্দময়! বলিতে বলিতেই অনির্বচনীয় করুণায় তাঁহার দু’চক্ষু মুদিয়া আসিল, এবং হাত-দুটি একত্র করিয়া ধীরে ধীরে ক্রোড়ের উপর রাখিতেই সেই নিমীলিত নেত্র-প্রান্ত হইতে পিতৃস্নেহ যেন অজস্র অশ্রুধারায় ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। আর কম্পিত ওষ্ঠাধর-দুটি কাঁপিয়া কাঁপিয়া অস্ফুটকণ্ঠে বলিতে লাগিল, মা! মা! তুই কোথায় আছিস—একবার কেবল ফিরিয়া আয়! আমি তোকে পৃথিবীতে আনিয়াছি, আমি তোকে বুকে করিয়া বড় করিয়াছি—মা, তোর সমস্ত অপরাধ, সমস্ত অপমান লাঞ্ছনা লইয়াই আর একবার পিতৃক্রোড়ে ফিরিয়া আয় অচলা, আমি বুক দিয়া তোর সকল ক্ষত, সকল জ্বালা মুছিয়া লইয়া আবার তেমনি করিয়াই মানুষ করিব। আমরা লোকালয়ে আসিব না, ঘরের বাহির হইব না, শুধু তুই আর আমি—

বাবা!

বৃদ্ধ মুখ ফিরিয়া মৃণালের মুখের পানে চাহিলেন, বোধ করি, একবার আপনাকে সংযত করিবার চেষ্টাও করিলেন, কিন্তু পরক্ষণেই মেঝের উপর লুটাইয়া পড়িয়া বালকের মত আর্তকণ্ঠে কাঁদিয়া উঠিলেন—মা! মা! আমার বুক ফেটে গেল। সবাই তাকে কত দুঃখ, কত ব্যথাই না দিচ্চে! আর আমি পারি না!

মৃণাল কিছুই বলিল না, শুধু কাছে আসিয়া তাঁহার ভূলুণ্ঠিত মাথাটি নীরবে কোলে তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। তাহার নিজের দু’চোখ বাহিয়াও জল পড়িতে লাগিল।

প্রথম ফাল্গুনের এই মেঘ-ঢাকা দিনটি হয়ত এমনিভাবেই শেষ হইয়া যাইত, কিন্তু হঠাৎ কেদারবাবু চোখ চাহিয়া উঠিয়া বসিলেন, কহিলেন, মৃণাল, মহিমকে চিঠি লিখলে কি জবাব পাওয়া যাবে না?

35 Shares