গৃহদাহ

কেন যাবে না বাবা? আমার ত মনে হয় কাল-পরশুর মধ্যেই তাঁর উত্তর পাবো।

তুমি কি তাঁকে কিছু লিখেছ?

মৃণাল ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, হাঁ।

চিঠিতে কি লেখা হয়েছে, এ কথা বৃদ্ধ সঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করিলেন না। বাইরে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, এখনো খানিক বেলা আছে, আমি একটু ঘুরে আসি। বলিয়া তিনি গায়ের কাপড়খানি টানিয়া লাঠিটি হাতে করিলেন, কিন্তু দুই-এক পদ অগ্রসর হইয়া সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, কিন্তু দেখ মা—

কি বাবা?

আমি ভয় করচি—না, ভয় ঠিক নয়—কিন্তু আমি ভাবচি যে—

কিসের বাবা?

কি জানো মা, আমি ভাবচি—আচ্ছা, তুমি কি মনে কর মৃণাল, আমরা যেতে চাইলে মহিম আপত্তি করবে?

এই ভয় এবং ভাবনা দুই-ই মৃণালের যথেষ্ট ছিল এবং মনে মনে ইহার জবাবটাও সে একপ্রকার ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল; তাই তৎক্ষণাৎ কহিল, এখন সে খোঁজে আমাদের কাজ কি বাবা? তাঁর ঠিকানা জানলেই আমরা চলে যাবো—তার পরে সেজদা যখন আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন, তখন দুনিয়ায় জানবার মত অনেক কথা আপনি জানা যাবে বাবা। সে আর কাউকে প্রশ্ন করতে হবে না।

কেদারবাবু মুহূর্তকাল স্থির থাকিয়া কহিলেন, তা হলে সত্যিই তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

মৃণাল কহিল, সত্যি। কিন্তু আমি ত তোমার সঙ্গে যাবো না বাবা, বরঞ্চ তুমিই আমার সঙ্গে যাবে।

প্রত্যুত্তরে বৃদ্ধ আবার একটা কি বলিতে গেলেন, কিন্তু কেবলমাত্র ক্ষণকাল তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া মুখ ফিরাইয়া নীরবে বাহির হইয়া গেলেন।

ঠিক এমনি এক ফাল্গুনের অপরাহ্নবেলায় এই বাঙলা দেশের বাহিরে আরও দুটি নর-নারীর চোখের জল সেদিন এমনি অসংবরণীয় হইয়া উঠিতেছিল; সুরেশ যখন শিলমোহর করা বড় খামখানি অচলার হাতে দিয়া কহিল, এতদিন দিই দিই করেও এ কাগজখানি তোমার হাতে দিতে আমার সাহস হয়নি, কিন্তু আজ আমার আর না দিলেই নয়।

অচলা খামখানি হাতে লইয়া দ্বিধাভাবে কহিল, তার মানে?

সুরেশ একটু হাসিয়া বলিল, দুনিয়ায় আমার সাহস হয় না, এমন ভয়ঙ্কর আশ্চর্য বস্তু আবার কি ছিল, এ ত তুমি ভাবচো? ভাবতে পারো—আমিও অনেক ভেবেচি। এর মানে যদি কিছু থাকে, একদিন ত প্রকাশ পাবেই। কিন্তু অনেক অপমান, অনেক দুঃখের বোঝাই ত সংসারে তুমি আমার কাছে অর্থ না বুঝেই নিয়েচ—একে তেমনি নাও অচলা।

অচলা শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এর মধ্যে কি আছে?

সুরেশ হাতজোড় করিয়া কহিল, এতদিন যা কিছু তোমার কাছে পেয়েছি, ডাকাতের মত জোর করেই পেয়েছি। কিন্তু আজ শুধু একটি জিনিস ভিক্ষে চাইচি—এ কথা তুমি জানতে চেয়ো না।

অচলা চুপ করিয়া রহিল, ইহার পরে কি বলিবে, ভাবিয়া পাইল না।

বাহিরে পর্দার আড়াল হইতে বেহারা ডাকিয়া কহিল, বাবুজী, এক্কাওয়ালা বলচে, আর দেরি করলে পৌঁছুতে রাত্রি হয়ে যাবে। পথে হয়ত ঝড়বৃষ্টিও হতে পারে।

অচলা চকিত হইয়া কহিল, আজ আবার তুমি কোথায় যাবে? এমন সময়ে?

সুরেশ হাসিমুখে সংশোধন করিয়া কহিল, অর্থাৎ এমন অসময়ে। যাচ্ছি ওই মাঝুলিতেই। প্লেগের ডাক্তার কিছুতে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ গ্রামগুলো একেবারে শ্মশান হয়ে পড়েচে। এবার পাঁচ-সাত দিন থাকবে হবে—আর কে জানে, হয়ত একেবারেই বা থেকে যেতে হবে। বলিয়া সে আবার একটু হাসিল।

অচলা স্থির হইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে নিজেও কিছু কিছু সংবাদ জানিত; সাত-আট ক্রোশ দূরে কতকগুলা গ্রাম যে সত্যই এ বৎসরে প্লেগে শ্মশান হইয়া যাইতেছে, এ খবর সে শুনিয়াছিল। শহর হইতে এতদূরে এই ভীষণ মহামারীতে দরিদ্রের চিকিৎসা করিতে যে চিকিৎসকের অভাব ঘটিবে, ইহাও বিচিত্র নয়। সুরেশ বহু টাকার ঔষধ-পথ্য যে গোপনে দিকে দিকে প্রেরণ করিতেছে, ইহাও সে টের পাইয়াছিল; এবং নিজেও প্রায় ভোরে উঠিয়া কোথাও-না-কোথাও চলিয়া যায়। ফিরিতে কখনো সন্ধ্যা, কখনো রাত্রি হয়—পরশু ত আসিতে পারে নাই, কিন্তু সে যে বাড়ি ছাড়িয়া, তাহাকে ছাড়িয়া, একেবারে কিছুদিনের মত সেই মরণের মাঝখানে গিয়া বাস করিবার সঙ্কল্প করিবে, ইহা সে কল্পনাও করে নাই। তাই কথাটা শুনিয়া ক্ষণকালের জন্য সে কেবল নিঃশব্দে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। এই যে মহাপাপিষ্ঠ, যে ভগবান মানে না, পাপ-পুণ্য মানে না, যে কেবলমাত্র বন্ধু ও তাহার নিরপরাধা স্ত্রীর এত বড় সর্বনাশ অবলীলাক্রমে সাধিয়া বসিল, কোন বাধা মানিল না—তাহার মুখের প্রতি সে যখনই চাহিয়াছে, তখনই সমস্ত মন বিতৃষ্ণায় বিষ হইয়া গিয়াছে—কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তাহারই পানে চাহিয়া সমস্ত অন্তর তাহার বিষে নয়, অকস্মাৎ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। ওই লোকটির ওষ্ঠের কোণে তখনও একটুখানি হাসির রেখা ছিল—অত্যন্ত ক্ষীণ, কিন্তু সেইটুকু হাসির মধ্যেই যেন অচলা বিশ্বের সমস্ত বৈরাগ্য ভরা রহিয়াছে দেখিতে পাইল। মুখে তাহার উদ্বেগ নাই, উত্তেজনা নাই, এই যে মৃত্যুর মধ্যে গিয়া নামিয়া দাঁড়াইতে যাত্রা করিয়াছে—তথাপি মুখের উপর শঙ্কার চিহ্নমাত্র নাই। তবে এই নিরীশ্বর ঘোর স্বার্থপরের কাছেও কি তাহার নিজের প্রাণটা এতই সস্তা! সংসারে ভোগ ছাড়া যে লোক আর কিছুই বুঝে না—ভোগের সমস্ত আয়োজনের মধ্যে মগ্ন রহিয়াও কি বাঁচিয়া থাকাটা তাহার এমনি অকিঞ্চিৎকর, এমনি অবহেলার বস্তু যে, এতই সহজে সমস্ত ছাড়িয়া যাইতে এক নিমিষে প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল? হয়ত না ফিরিতেও পারি! ইহা আর যাহাই হোক, পরিহাস নয়। কিন্তু কথাটা কি এতই সহজে বলিবার?

অকস্মাৎ ভিতরের ধাক্কায় সে যেন চঞ্চল হইয়া উঠিল; হাতের কাগজখানা দেখাইয়া প্রশ্ন করিল, এটা কি তোমার উইল?

সুরেশও প্রশ্ন করিল, যা এইমাত্র ভিক্ষে দিলে অচলা, তাই কি তবে ফিরে নিতে চাও?

অচলা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আচ্ছা, আমি জানতে চাইনে। কিন্তু আমি তোমাকে যেতে দিতে পারবো না।

কেন?

প্রত্যুত্তরে অচলা সেই খামখানাই পুনরায় নাড়াচাড়া করিয়া একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, তুমি আমার যাই কেননা করে থাকো, আমার জন্যে তোমাকে আমি মরতে দেবো না।

35 Shares