গৃহদাহ

রাক্ষুসী জ্বর নিয়েই কলিকাতা থেকে ফিরেছে—খবর পেলুম, জ্যাঠামশাই নিজেও নাকি কাল থেকে জ্বরে পড়েছেন।

আসা পর্যন্ত তুমি কি একদিনও তাঁদের বাড়ি যাওনি?

না।

তাঁরাও কেউ আসেন নি?

অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না।

রামবাবু নিজেও আসেন নি?

না।

এ বাটীতে আসিয়া পর্যন্ত সুরেশ প্লেগ লইয়া আপনাকে এমনি ব্যাপৃত রাখিয়াছিল যে, গৃহস্থালী ও আত্মীয়তার এই-সকল ছোটখাটো ত্রুটি সে লক্ষ্য করে নাই। তাই কথা শুনিয়া যাথার্থই বিস্ময়ভরে কহিল, আশ্চর্য! আচ্ছা যাও।

অচলা বলিল, আশ্চর্য তাঁদের তত নয়, যত আমাদের। একজনের জ্বর, একজন নিজেও অসুখে না পড়া পর্যন্ত আত্মীয়দের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন। উচিত ছিল আমাদেরই যাওয়া।

আচ্ছা, যাও। একটু সকাল সকাল ফিরো।

অচলা একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, তুমিও সঙ্গে চল।

আমাকে কেন?

অচলা রাগ করিয়া কহিল, নিজের অসুখের কথা মনে করতে না পারো, অন্ততঃ ডাক্তার বলেও চল।

আচ্ছা চল, বলিয়া সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং কাপড় ছাড়িতে পাশের ঘরে চলিয়া গেল।

এক্কাওয়ালা বেচারা কোন কিছুই হুকুম না পাইয়া তখনও অপেক্ষা করিয়াছিল। নীচে নামিয়া তাহাকে দেখিয়াই অচলা খামকা রাগিয়া উঠিয়া বেহারাকে তাহার কৈফিয়ত চাহিল এবং ভাড়া দিয়া তৎক্ষণাৎ বিদায় দিতে আদেশ করিল। সে সুরেশের মুখের দিকে চাহিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কাল—

অচলাই তাহার জবাব দিল, কহিল না। বাবুর যাওয়া হবে না, এক্কার দরকার নেই।

গাড়িতে উঠিয়া সুরেশ সম্মুখের আসনে বসিতে যাইতেছিল, আজ অচলা সহসা তাহার জামার খুঁট ধরিয়া টানিয়া পাশে বসিতে ইঙ্গিত করিল। গাড়ি চলিতে লাগিল, কেহই কোন কথা কহিল না, পাশাপাশি বসিয়া দু’জনেই দুইদিকের খোলা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল।

বাগানের গেট পার হইয়া গাড়ি যখন রাস্তায় আসিয়া পড়িল, তখন সুরেশ আস্তে আস্তে ডাকিল, অচলা!

কেন?

আজকাল আমি কি ভাবি জানো?

না।

এতকাল যা ভেবে এসেছি ঠিক তার উলটো। তখন ভাবতুম, কি করে তোমাকে পাবো; এখন অহর্নিশি চিন্তা করি, কি উপায়ে তোমাকে মুক্তি দেব। তোমার ভার যেন আমি আর বইতে পারিনে।

এই অচিন্ত্যপূর্ব একান্ত নিষ্ঠুর আঘাতের গুরুত্বে ক্ষণকালের জন্য অচলার সমস্ত দেহ-মন একেবারে অসাড় হইয়া গেল। ঠিক যে বিশ্বাস করিতে পারিল তাহাও নয়, তথাপি অভিভূতের ন্যায় বসিয়া থাকিয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, আমি জানতুম। কিন্তু এ ত—

সুরেশ বলিল, হাঁ, আমারই ভুল। তোমরা যাকে বল পাপের ফল। কিন্তু তবুও কথাটা সত্য। মন ছাড়া যে দেহ, তার বোঝা এমন অসহ্য ভারী, এ স্বপ্নেও ভাবিনি।

অচলা চোখ তুলিয়া কহিল, তুমি কি আমাকে ফেলে চলে যাবে?

সুরেশ লেশমাত্র দ্বিধা না করিয়া জবাব দিল, বেশ ধর তাই।

ওই নিঃসঙ্কোচ উত্তর শুনিয়া অচলা একেবারে নীরব হইয়া গেল! তাহার রুদ্ধ হৃদয় মথিত করিয়া কেবল এই কথাটাই চারিদিকে মাথা কুটিয়া ফিরিতে লাগিল, এ সেই সুরেশ!

এ সেই সুরেশ! আজ ইহারই কাছে সে দুঃসহ বোঝা, আজ সেই-ই তাহাকে ফেলিয়া যাইতে চাহে! কথাটা মুখের উপর উচ্চারণ করিতেও আজ তাহার কোথাও বাধিল না।

অথচ পরমাশ্চর্য এই যে, এই লোকটিই তাহার সীমাহীন দুঃখের মূল! কাল পর্যন্ত ইহার বাতাসে সমস্ত দেহ বিষে ভরিয়া গিয়াছে!

মেঘাবৃত অপরাহ্ন-আকাশতলে নির্জন রাজপথ প্রতিধ্বনিত করিয়া গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটিয়াছে, তাহারই মধ্যে বসিয়া এই দুটি নরনারী একেবারে নির্বাক! সুরেশ কি ভাবিতেছিল সেই জানে, কিন্তু তাহার উচ্চারিত বাক্যের কল্পনাতীত নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করিয়াও আজ নূতন ভয়ে অচলার সমস্ত মন পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সুরেশ নাই—সে একা। এই একাকিত্ব যে কত বৃহৎ, কিরূপ আকুল, তাহা বিদ্যুদ্বেগে তাহার মনের মধ্যে খেলিয়া গেল। অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় যে তরণী বাহিয়া সে সংসারসমুদ্রে ভাসিয়াছে, সে যে অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যেই তিল তিল করিয়া ডুবিতেছে, ইহা তাহার চেয়ে বেশি কেহ জানে না, তথাপি সেই সুপরিচিত ভয়ঙ্কর আশ্রয় ছাড়িয়া আজ সে দিক্‌চিহ্নহীন সমুদ্রে ভাসিতেছে, ইহা কল্পনা করিয়াই তাহার সর্বশরীর হিম হইয়া গেল। আজ তাহার কেউ নাই; তাহাকে ভালবাসিতে, তাহাকে ঘৃণা করিতে, তাহাকে রক্ষা করিতে, তাহাকে হত্যা করিতে, কোথাও কেহ নাই; সংসারে সে একেবারেই সঙ্গ-বিহীন! এই কথা মনে করিয়া তাহার নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল।

সহসা তাহার অশক্ত অবশ ডান হাতখানি খপ করিয়া সুরেশের ক্রোড়ের উপর পড়িতেই সে চমকিয়া চাহিল। অচলা নিরুদ্বেগ-কণ্ঠ প্রাণপণে পরিষ্কার করিয়া কহিল, আর কি তুমি আমাকে ভালবাস না?

সুরেশ হাতখানি তাহার সযত্নে নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করিয়া কহিল, এ প্রশ্নের জবাব তেমন নিঃসংশয়ে দিতে পারিনে অচলা, মনে হয় সে যাই হোক, এ কথা সত্য যে, এই ভূতের বোঝা বয়ে বেড়াবার আর আমার শক্তি নেই।

অচলা আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া অত্যন্ত মৃদু করুণকণ্ঠে কহিল, তুমি আর কোথায়ও আমাকে নিয়ে চল—

যেখানে কোন বাঙালী নেই?

হাঁ। যেখানে লজ্জা আমাকে প্রতিনিয়তই বিঁধবে না—

সেখানে কি আমাকে তুমি ভালবাসতে পারবে অচলা? এ কি সত্য? বলিতে বলিতেই আকস্মিক আবেগে সে তাহার মাথাটা বুকের উপর টানিয়া লইয়া ওষ্ঠাধর চুম্বন করিল।

অপমানে আজও অচলার মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল, ঠোঁট দুটি ঠিক তেমনি বিছার কামড়ের মত জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু তবুও সে ঘাড় নাড়িয়া চুপি চুপি বলিল, হাঁ। এক সময় তোমাকে আমি ভালবাসতুম। না না—ছি—কেউ দেখতে পাবে। বলিয়া সে আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া সোজা হইয়া বসিল। কিন্তু হাতখানি তাহার মুঠার মধ্যে ধরাই রহিল, সে তাহারই উপর পরম স্নেহে একটুখানি চাপ দিয়া কেবল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল।

গাড়ি বড় রাস্তা ছাড়িয়া রামবাবুর বাংলোসংলগ্ন উদ্যানের ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিল এবং সেই বিরাট ওয়েলার যুগলবাহিত বিপুলভার অশ্বযান সমস্ত গৃহ প্রকম্পিত করিয়া দেখিতে দেখিতে গাড়িবারান্দার নীচে আসিয়া থামিল।

35 Shares