গৃহদাহ

জমকালো নূতন পোশাকপরা সহিসেরা গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল এবং সুরেশ নিজে নামিয়া হাত ধরিয়া অচলাকে অবতরণ করাইল। অচলার দৃষ্টি ছিল উপরের বারান্দায়। তথায় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে রাক্ষুসীও বিছানা ছাড়িয়া ছুটিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল; বহুদিনের পর চোখে চোখে হইতে দুই সখীর মুখেই হাসি ফুটিয়া উঠিল। রামবাবু নীচেই ছিলেন, তিনি গায়ের বালাপোশখানা ফেলিয়া দিয়া আনন্দে সস্নেহে আহ্বান করিলেন, এসো এসো, আমার মা এসো!

এই পরিচিত কণ্ঠস্বরের ব্যগ্র-ব্যাকুল আবাহনে তাহার হাসিমাখা চোখের দৃষ্টি মুহূর্তে নামিয়া আসিয়া বৃদ্ধের উপর নিপতিত হইল; কিন্তু তাহারই পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আজ মহিম—তাহারই প্রতি চাহিয়া যেন পাথর হইয়া গিয়াছে। চোখে চোখে মিলিল, কিন্তু সে চোখে আর পলক পড়িল না। সর্বাঙ্গে মণি-মুক্তা অচলার তেমনি ঝলসিতে লাগিল, হীরা-মানিকের দীপ্তি লেশমাত্র নিষ্প্রভ হইল না, কিন্তু তাহাদেরি মাঝখানে প্রস্ফুটিত কমল যেন চক্ষের নিমিষে মরিয়া গেল।

কিন্তু আসন্ন সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোকে বৃদ্ধের ভুল হইল। অপরিচিত পুরুষের সম্মুখে তাহাকে সহসা লজ্জায় ম্লান ও বিপন্ন কল্পনা করিয়া তিনি ব্যস্ত হইয়া অচলার আনত ললাট দুই হাতে ধরিয়া ফেলিয়া বলিলেন, থাক মা, তোমাকে পায়ের ধূলা নিতে হবে না, তুমি ওপরে যাও—

অচলা কিছুই বলিল না, টলিতে টলিতে চলিয়া গেল।

রামবাবু কহিলেন, সুরেশবাবু, ইনি—

সুরেশ কহিল, বিলক্ষণ! আমরা যে এক ক্লাসের—ছেলেবেলা থেকে দু’জনে আমরা—, বলিয়া সহসা হাসির চেষ্টায় মুখখানা বিকৃত করিয়া বলিল, কি মহিম, হঠাৎ তুমি যে—

কিন্তু কথাটা আর শেষ হইতে পারিল না। মহিম মুখ ফিরাইয়া দ্রুতপদে ঘরের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিল।

হতবুদ্ধি বৃদ্ধ সুরেশের মুখের প্রতি চাহিলেন এবং সুরেশও প্রত্যুত্তরে আর একটা হাসির প্রয়াস করিতে গেল, কিন্তু তাহাও সম্পূর্ণ হইতে পাইল না। উপরে যাইবার কাঠের সিঁড়িতে অকস্মাৎ গুরুতর শব্দ শুনিয়া দুইজনেই স্তব্ধ হইয়া গেলেন। একটা গোলমাল উঠিল; রামবাবু ছুটিয়া গিয়া দেখিলেন, অচলা উপুড় হইয়া পড়িয়া। সে দুই-তিনটি ধাপ উঠিতে পারিয়াছিল মাত্র, তাহার পরেই মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গিয়াছে।

একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

ফিরিবার পথে গাড়ির কোণে মাথা রাখিয়া চোখ বুজিয়া অচলা এই কথাটাই ভাবিতেছিল, আজিকার এই মূর্ছাটা যদি না ভাঙ্গিত। নিজের হাতে নিজেকে হত্যা করিবার বীভৎসতাকে সে মনে স্থান দিতেও পারে না, কিন্তু এমনি কোন শান্ত স্বাভাবিক মৃত্যু—হঠাৎ জ্ঞান হারাইয়া ঘুমাইয়া পড়া—তার পরে আর না জাগিতে হয়। মরণকে এমন সহজে পাইবার কি কোন পথ নাই? কেউ কি জানে না?

সুরেশ তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিল, তুমি যে আর কোথাও যেতে চেয়েছিলে, যাবে?

চল।

এর পরে কাল ত এখানে মুখ দেখানো যাবে না।

কিন্তু তিনি ত কোন কথাই কাউকে বলবেন না।

সুরেশের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল, ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, না। মহিমকে আমি জানি, সে ঘৃণায় আমাদের দুর্নামটা পর্যন্ত মুখে আনতে চাইবে না।

কথাটা সুরেশ সহজেই কহিল, কিন্তু শুনিয়া অচলার সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। তারপরে যতক্ষণ না গাড়ি গৃহে আসিয়া থামিল, ততক্ষণ পর্যন্ত উভয়েই নির্বাক হইয়া রহিল। সুরেশ তাহাকে সযত্নে, সাবধানে নামাইয়া দিয়া কহিল, তুমি একটুখানি ঘুমোবার চেষ্টা কর গে অচলা, আমার কতকগুলো জরুরি চিঠিপত্র লেখবার আছে। বলিয়া সে নিজের পড়িবার ঘরে চলিয়া গেল।

শয্যায় শুইয়া অচলা ভাবিতেছিল, এই ত তাহার একুশ বৎসর বয়স, ইহার মধ্যে এমন অপরাধ কাহার কাছে সে কি করিয়াছে যেজন্য এতবড় দুর্গতি তাহার ভাগ্যে ঘটিল। এ চিন্তা নূতন নয়, যখন-তখন ইহাই সে আপনাকে আপনি প্রশ্ন করিত এবং শিশুকাল হইতে যতদূর স্মরণ হয় মনে করিবার চেষ্টা করিত। আজ অকস্মাৎ মৃণালের একদিনের তর্কের কথাগুলি তাহার মনে পড়িল এবং তাহারই সূত্র ধরিয়া সমস্ত আলোচনাই সে একটির পর একটি করিয়া মনে মনে আবৃত্তি করিয়া গেল। নিজের বিবাহিত জীবনটা স্বামীর সহিত একপ্রকার তাহার বিরোধের মধ্যে দিয়াই কাটিয়াছে। কেবল শেষ কয়টি দিন তাঁহার রুগ্নশয্যায় স্বামীকে সে বড় আপনার করিয়া পাইয়াছিল। তাঁহার জীবনের যখন আর কোন শঙ্কা নাই, মন যখন নিশ্চিন্ত নির্ভর হইয়াছে, তখনকার সে স্নিগ্ধ, সহজ ও নির্মল আনন্দের মাঝে অপরের দুর্ভাগ্য ও বেদনা যখন তাহার বড় বেশি বাজিত তখন একদিন মৃণালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া অশ্রুরুদ্ধস্বরে কহিয়াছিল, ঠাকুরঝি, তুমি যদি আমাদের সমাজের, আমাদের মতের হতে, তোমার সমস্ত জীবনটাকে আমি ব্যর্থ হতে দিতুম না।

মৃণাল হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কি করতে সেজদি, আমার আবার একটা বিয়ে দিতে?

অচলা কহিয়াছিল, নয় কেন? কিন্তু থামো ঠাকুরঝি, তোমার পায়ে পড়ি, আর শাস্ত্রের দোহাই দিয়ো না। ও মল্লযুদ্ধ এত হয়ে গেছে যে, হবে শুনলেও আমার ভয় করে।

মৃণাল তেমনি সহাস্যে বলিয়াছিল, ভয় করবার কথাই বটে। কারণ তাঁদের হুড়োমুড়িটা যে কখন কোন্‌দিকে চেপে আসবে তার কিছুই বলবার জো নাই। কিন্তু একটা কথা তুমি ভাবোনি সেজদি, যে, তাঁরা যুদ্ধ করেন কেবল যুদ্ধ ব্যবসা বলে, কেবল তাতে গায়ে জোর আর হাতে অস্ত্র থাকে বলে। তাই তাঁদের জিতহার শুধু তাঁদেরই, আমাদের যায় আসে না। আমাদের ত কোন পক্ষই কোন কথা জিজ্ঞেসা করেন না।

অচলা প্রশ্ন করিয়াছিল, কিন্তু করলে কি হতো?

মৃণাল বলিয়াছিল, সে ঠিক জানিনে ভাই। হয়ত তোমারি মত ভাবতে শিখতুম, হয়ত তোমার প্রস্তাবেই রাজি হতুম, একটা পাত্রও হয়ত এতদিনে জুটে যেতে পারত। বলিয়া সে হাসিয়াছিল।

এই হাসিতে অচলা অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া উত্তর দিয়াছিল, আমাদের সমাজের সম্বন্ধে কথা উঠলেই তুমি অবজ্ঞার সঙ্গে বল, সে আমি জানি। কিন্তু আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দাও, যাঁরাই এই নিয়ে যুদ্ধ করেন, তাঁরা কি সবাই ব্যবসায়ী? কেউ কি সত্যিকার দরদ নিয়ে লড়াই করেন না?

35 Shares