গৃহদাহ

মৃণাল জিভ কাটিয়া বলিয়াছিল, অমন কথা মনে আনলেও পাপ হয় সেজদি। কিন্তু তা নয় ভাই। কাল সকালেই ত আমি চলে যাচ্ছি, আবার কবে দেখা হবে জানিনে, কিন্তু যাবার আগে একটা তামাশাও কি করতে পারব না? বলিতে বলিতেই তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িয়াছিল। সামলাইয়া লইয়া পরে গম্ভীর হইয়া কহিয়াছিল, কিন্তু তুমি ত আমার সকল কথা বুঝতে পারবে না ভাই। বিয়ে জিনিসটি তোমাদের কাছে শুধু একটা সামাজিক বিধান। তাই তার সম্বন্ধে ভালমন্দ বিচার চলে, তার মতামত যুক্তিতর্কে বদলায়। কিন্তু আমাদের কাছে এ ধর্ম। স্বামীকে ছেলেবেলা থেকে এই রূপেতেই গ্রহণ করে আসি। এ বস্তুটি যে তাই সকল বিচার-বিতর্কের বাইরে।

বিস্মিত অচলা প্রশ্ন করিয়াছিল, বেশ তাও যদি হয়, ধর্ম কি মানুষের বদলায় না ঠাকুরঝি?

মৃণাল কহিয়াছিল, ধর্মের মতামত বদলায়, কিন্তু আসল জিনিসটি কে আর বদলায় ভাই সেজদি? তাই এত লড়াই-ঝগড়ার মধ্যেও সেই মূল জিনিসটি আজও সকল জাতিরই এক হয়ে রয়েছে। স্বামীর দোষ-গুণের আমরাও বিচার করি, তাঁর সম্বন্ধে মতামত আমাদেরও বদলায়—আমারাও ত ভাই মানুষ! কিন্তু স্বামী জিনিসটি আমাদের ধর্ম, তাই তিনি নিত্য। জীবনেও নিত্য, মৃত্যুতেও নিত্য। তাঁকে আর আমরা বদলাতে পারিনে।

অচলা ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিয়াছিল, এই যদি সত্যি, তবে এত অনাচার আছে কেন?

মৃণাল বলিয়াছিল, ওটা থাকবে বলেই আছে। ধর্ম যখন থাকবে না, তখন ওটাও থাকবে না। বেড়াল-কুকুরের ত ভাই অনাচার নেই।

অচলা হঠাৎ কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়াছিল, এত যদি তোমার সমাজের শিক্ষা, তবে শিক্ষা যাঁরা দেন, তাঁদের এত সন্দেহ, এত সাবধান হওয়া তবু কিসের জন্যে? এত পর্দা, এত বাধাবাধি—সমস্ত দুনিয়া থেকে আড়াল করে লুকিয়ে রাখবার এত প্রাণপণ চেষ্টা কেন? এত জোর-করা সতীত্বের দাম বুঝতুম পরীক্ষার অবকাশ থাকলে।

তাহার উত্তাপ দেখিয়া মৃণাল চমকিয়া হাসিয়া কহিয়াছিল, এ বিধি-ব্যবস্থা যাঁরা করে গেছেন, উত্তর জিজ্ঞাসা কর গে ভাই তাঁদের। আমরা শুধু বাপ-মায়ের কাছে যা শিখেছি, তাই কেবল পালন করে আসচি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে জোর করে বলতে পারি সেজদি, স্বামীকে ধর্মের ব্যাপার, পরকালের ব্যাপার বলে যে যথার্থই নিতে পেরেচে, তার পায়ের বেড়ি বেঁধেই দাও আর কেটেই দাও, তার সতীত্ব আপনা-আপনি যাচাই হয়ে গেছে। বলিয়া সে একটুখানি থামিয়া ধীরে ধীরে বলিয়াছিল, আমার স্বামীকে ত তুমি দেখেচ? তিনি বুড়োমানুষ ছিলেন, সংসারে তিনি দরিদ্র, রূপ-গুণও তাঁর সাধারণ পাঁচজনের বেশি ছিল না, কিন্তু তিনিই আমার ইহকাল, তিনিই আমার পরকাল। এই বলিয়া সে চোখ বুজিয়া পলকের জন্য বোধ করি বা তাঁহাকেই অন্তরের মধ্যে দেখিয়া লইল, তার পরে চাহিয়া একটুখানি ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, উপমাটা হয়ত ঠিক হবে না সেজদি; কিন্তু এটা মিথ্যা নয় যে, বাপ তাঁর কানা-খোঁড়া ছেলেটির উপরেই সমস্ত স্নেহ ঢেলে দেন। অপরের সুন্দর সুরূপ ছেলে মুহূর্তের তরে হয়ত তাঁর মনে একটা ক্ষোভের সৃষ্টি করে, কিন্তু পিতৃধর্ম তাতে লেশমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। যাবার সময়ে তাঁর সর্বস্ব তিনি কোথায় রেখে যান, এ ত তুমি জানো। কিন্তু নিজের পিতৃত্বের প্রতি সংশয়ে যদি কখনো তাঁর পিতৃধর্ম ভেঙ্গে যায়, তখন এই স্নেহের বাষ্পও কোথাও খুঁজে মেলে না। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ও চিন্তার ধারা আলাদা ভাই, আমার এই উপমাটা ও কথাগুলো তুমি হয়ত ঠিক বুঝতে পারবে না, কিন্তু এ কথা আমার ভুলেও বিশ্বাস করো না যে, স্বামীকে যে স্ত্রী ধর্ম বলে অন্তরের মধ্যে ভাবতে শেখেনি, তার পায়ের শৃঙ্খল চিরদিন বন্ধই থাক, আর মুক্তই থাক এবং নিজের সতীত্বের জাহাজটাকে যে যত বড়, যত বৃহৎই কল্পনা করুক, পরীক্ষার চোরাবালিতে ধরা পড়লে তাকে ডুবতেই হবে। সে পর্দার ভিতরে ডুববে, বাইরেও ডুববে।

তাহাই ত হইল। তখন এ সত্য অচলা উপলব্ধি করে নাই, কিন্তু আজ মৃণালের সেই চোরাবালি যখন তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া অহরহ রসাতলের পানে টানিতেছে, তখন বুঝিতে আর বাকি নাই, সেদিন কি কথাটা সে অত করিয়া তাহাকে বুঝাইতে চাহিয়াছিল। নিরবরুদ্ধ সমাজের অবাধ স্বাধীনতায় চোখ-কান খোলা রাখিয়াই সে বড় হইয়াছে, নিজের জীবনটাকে সে নিজে বাছিয়া গ্রহণ করিয়াছে, এই ছিল তাহার গর্ব, কিন্তু পরীক্ষার একান্ত দুঃসময়ে এ-সকল তাহার কোন কাজে লাগিল না। তাহার বিপদ আসিল অত্যন্ত সঙ্গোপনে বন্ধুর বেশে; সে আসিল জ্যাঠামহাশয়ের স্নেহ ও শ্রদ্ধার ছদ্মরূপ ধরিয়া। এই একান্ত শুভানুধ্যায়ী স্নেহশীল বৃদ্ধের পুনঃ পুনঃ ও নির্বন্ধাতিশয্যে যে দুর্যোগের রাত্রে সে সুরেশের শয্যায় গিয়া আত্মহত্যা করিয়া বসিল, সেদিন একমাত্র যে তাহাকে রক্ষা করিতে পারিত, সে তাহার অত্যাজ্য সতীধর্ম—যাহা মৃণাল তাহাকে জীবনে মরণে অদ্বিতীয় ও নিত্য বলিয়া বুঝাইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু সেদিন তাহার বাহিরের খোলসটাই বড় হইয়া তাহার ধর্মকে পরাভূত করিয়া দিল। তাহাদের আজন্ম শিক্ষা ও সংস্কার ভিতরটাকে তুচ্ছ করিয়া, কারাগার ভাবিয়া বাহিরের জগৎটাকে চিরদিন সকলের উপর স্থান দিয়াছে; যে ধর্ম গুপ্ত, যে ধর্ম গুহাশায়ী, সেই অন্তরের অব্যক্ত ধর্ম কোনদিন তাহার কাছে সজীব হইয়া উঠিতে পারে নাই। তাই বাহিরের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে সেদিনও সে ভদ্রমহিলার সম্ভ্রমের বহির্বাসটাকেই লজ্জায় আঁকড়াইয়া রহিল, এই আবরণের মোহ কাটাইয়া আপনাকে নগ্ন করিয়া কিছুতে বলিতে পারিল না, জ্যাঠামশাই, আমি জানি, আমার এতদিনের পর্বত-প্রমাণ মিথ্যার পরে আজ আমার সত্যকে সত্য বলিয়া জগতে কেহই বিশ্বাস করিবে না; জানি, কাল তুমি ঘৃণায় আর আমার মুখ দেখিবে না, তোমার সতী-সাধ্বী পুত্রবধূর ঘরের দ্বারও কাল আমার মুখের উপর রুদ্ধ হইয়া লাঞ্ছনা আমার জগদ্ব্যাপ্ত হইয়া উঠিবে। সে সমস্তই সহিবে, কিন্তু তোমার আজিকার এই ভয়ঙ্কর স্নেহ আমার সহিবে না। বরঞ্চ এই আশীর্বাদ আমাকে তুমি কর জ্যাঠামশায়, আমার এতদিনের সতী নামের বদলে তোমাদের কাছে আজকার কলঙ্কই যেন আমার অক্ষয় হইয়া উঠিতে পারে। কিন্তু হায় রে! এ কথা তাহার মুখ দিয়া সেদিন কিছুতেই বাহির হইতে পারে নাই।

35 Shares