গৃহদাহ

বহুক্ষণ হইতে তাহার তৃষ্ণাবোধ হইয়াছিল, এখানেই কতকটা পথ নদীর উচ্চ পাড়ের উপর দিয়া যাইতে যাইতে একটা ঘাটের কাছে আসিয়া সে ডুলি থামাইয়া অবতরণ করিল এবং হাত-মুখ ধুইয়া জল খাইবার জন্য নীচে নামিতেই তাহার চোখে পড়িল, গোটা-দুই অর্ধগলিত শব অনতিদূরে আটকাইয়া রহিয়াছে। ইহাদের বীভৎস বিকৃতি তাহার মনের উপর এখন কোন আঘাতই করিল না। অত্যন্ত সহজেই সে হাত-মুখ ধুইয়া জল খাইয়া ধীরে ধীরে গিয়া তাহার খাটুলিতে বসিল। কোন অবস্থাতেই ইহা সে তাহার পক্ষে সম্ভবপর, কিছুকাল পূর্বে এ কথা বোধ করি সে চিন্তাও করিতে পারিত না।

ইহার পর হইতেই প্রায় গ্রামগুলাই পরিত্যক্ত, শূন্য, কদাচিৎ কোন অত্যন্ত দুঃসাহসী ব্যক্তি ভিন্ন যে যেথায় পারিয়াছে পলায়ন করিয়াছে। কোথাও শব্দ নাই, সাড়া নাই, ঘরদ্বার রুদ্ধ, অপরিচ্ছন্ন—মনে হয় যেন কুটীরগুলা পর্যন্ত মরণকে অনিবার্য জানিয়া চোখ বুজিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। এই মৃত্যুশাসিত নির্জন পল্লীগুলির ভিতর দিয়া চলিতে রঘুবীর ও বাহকদিগের চাপা-গলা এবং ত্রস্ত-ভীত পদক্ষেপে প্রতিমুহূর্তেই অচলাকে বিপদের বার্তা জানাইতে লাগিল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার ভয়ই হইল না, ইহার সহিত তাহার যেন কোন আজন্ম পরিচয় আছে, সমস্ত অন্তঃকরণ এমনি নির্বিকার হইয়া রহিল।

এইভাবে বাকি পথটা অতিবাহিত করিয়া ইহারা যখন মাঝুলিতে উপস্থিত হইল, তখন বেলা শেষ হইয়া আসিয়াছে। অচলার দৃঢ়-বিশ্বাস ছিল, তাহাদের পথের দুঃখ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হইবে। গ্রামের কৃতজ্ঞ নরনারী ছুটিয়া আসিয়া তাহাদের সংবর্ধনা করিয়া ডাক্তার সাহেবের দরবারে লইয়া যাইবে, তথায় রোগী ও তাহাদের আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের আনাগোনায়, ঔষধ-পথ্যের বিতরণের ঘটায় সমস্ত স্থানটা ব্যাপিয়া যে সমারোহ চলিতেছে, তাহার মধ্যে অচলার নিজের স্থানটা যে কোথায় হইবে, ইহার চিত্রটা সে একপ্রকার কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু আসিয়া দেখিল, তাহার কল্পনা কেবল নিছক কল্পনাই। তাহার সহিত ইহার কোথাও কোন অংশে মিল নাই, বরঞ্চ যে চিত্র পথের দুই ধারে দেখিতে দেখিতে সে আসিয়াছে, এখানেও সেই ছবি। এখানেও পথে লোক নাই, বাড়িঘর-দ্বার রুদ্ধ, ইহার কোথায় কোন্‌ পল্লীতে সুরেশ বাসা করিয়াছে, খুঁজিয়া পাওয়াই যেন কঠিন।

এই গ্রামে প্রত্যহই একটা হাট আজও বসে বটে এবং অন্য সময়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরাদমে চলিতেও থাকে সত্য, কিন্তু এখন দুর্দিনের বেচা-কেনা সারিয়া লোকজন অপরাহ্ণের বহু পূর্বেই পলাইয়াছে—ভাঙ্গা হাটের স্থানে স্থানে তাহার চিহ্ন পড়িয়া আছে মাত্র।

রঘুবীর খোঁজাখুঁজি করিয়া একটা দোকান বাহির করিল। বৃদ্ধ দোকানী ঝাঁপ বন্ধ করিতেছিল; সে কহিল, তাহার ছেলেমেয়েরা সবাই স্থানান্তরে গিয়াছে, কেবল তাহারা দুইজন বুড়া-বুড়ী দোকানের মায়া কাটাইয়া আজিও যাইতে পারে নাই। সুরেশের সম্বন্ধে এইটুকু মাত্র সন্ধান দিতে পারিল যে, ডাক্তার নন্দ পাঁড়ের নিমতলার ঘরে এতদিন ছিলেন বটে, কিন্তু এখনও আছেন কিংবা মামুদপুরে চলিয়া গিয়াছেন সে অবগত নয়।

মামুদপুর কোথায়?

সিধা ক্রোশ-দুই দক্ষিণে।

নন্দ পাঁড়ের বাড়িটা কোন্‌ দিকে?

বৃদ্ধ বাহির হইয়া দূরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া একটা বিপুল নিমগাছ দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই পথে গেলেই দেখা যাইবে।

অনতিকাল পরে ভীত পরিশ্রান্ত বাহকেরা যখন নিমতলায় আসিয়া খাটুলি নামাইল, তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। বাড়িটা বড়, পিছনের দিকে দুই-একটা পুরাতন ইঁটের ঘর দেখা যায়; কিন্তু অধিকাংশই খোলার। সম্মুখে প্রাচীর নাই—চমৎকার ফাঁকা। গৃহস্বামীকে দরিদ্র বলিয়াও মনে হয় না, কিন্তু একটা লোকও বাহির হইয়া আসিল না। কেবল প্রাঙ্গণের একধারে বাঁধা একটা টাটু-ঘোড়া ক্ষুৎপিপাসার নিবেদন জানাইয়া অত্যন্ত করুণকণ্ঠে অতিথিদের অভ্যর্থনা করিল।

সদর দরজা খোলা ছিল, রঘুবীর সাহস করিয়া ভিতরে গলা বাড়াইতেই দেখিতে পাইল, পাশের বারান্দায় চারপাইয়ের উপর সুরেশ শুইয়া আছে এবং কাছেই খুঁটিতে ঠেস দিয়া একজন অতিবৃদ্ধ স্ত্রীলোক বসিয়া ঝিমাইতেছে।

বাবুজী।

সুরেশ চোখ মেলিয়া চাহিল এবং কনুইয়ে ভর দিয়া মাথা তুলিয়া ক্ষণকাল তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া প্রশ্ন করিল, কে, বেয়ারা? রঘুবীর?

রঘুবীর সেলাম করিয়া কাছে গিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু প্রভুর রক্ত-চক্ষুর প্রতি চাহিয়া তাহার মুখের কথা সরিল না।

তুই এখানে?

রঘুবীর পুনরায় সেলাম করিল এবং বাহিরের দিকে ইঙ্গিত করিয়া শুধু কেবল বলিল, মাইজী—

এবার সুরেশ বিস্ময়ে সোজা উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোকে পাঠিয়েছেন?

রঘুবীর ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না, তিনি নিজেই আসিয়াছেন।

জবাব শুনিয়া সুরেশ এমন করিয়া তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল, যেন কথাটাকে ঠিকমত হৃদয়ঙ্গম করিতে তাহার বিলম্ব হইতেছে। তার পরে চোখ বুজিয়া ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল, কিছুই বলিল না।

অচলা আসিয়া যখন নীরবে খাটিয়ার একধারে তাহার গায়ের কাছেই উপবেশন করিল, তখন কিছুক্ষণের নিমিত্ত সে তেমনি নিমীলিত-নেত্রে মৌন হইয়া রহিল, ভদ্রতা রক্ষা করিতে সামান্য একটা ‘এসো’ বলিয়াও ডাকিতে পারিল না। শিশুকাল হইতে চিরদিন অত্যধিক যত্ন-আদরে লালিত-পালিত হইয়া আবেগে ও প্রবৃত্তির বশেই সে চলিয়াছে, ইহাদের সংযত করার শিক্ষা তাহার কোনকালে হয় নাই। এই শিক্ষা জীবনে সে প্রথম পাইয়াছিল, কেবল সেইদিন, যেদিন তাহার মুখের হাসিকে পদাঘাত করিয়া মুখ ফিরাইয়া মহিম ঘরে চলিয়া গেল। সেদিন একনিমেষে তাহার বুকের মধ্যে নীরবে যে কি বিপ্লব বহিয়া গেল, সে শুধু অন্তর্যামীই জানিলেন এবং আজও কেবল তিনিই দেখিলেন, ঐ শান্ত অচঞ্চল দেহটার সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া কতবড় ঝড় প্রবাহিত হইতেছে। সেদিনও মহিমের আঘাতকে সে যেমন করিয়া সহ্য করিয়াছিল, আজও তেমনি করিয়াই সে তাহার উন্মত্ত আবেগের সহিত নিঃশব্দে লড়াই করিতে লাগিল—তাহার লেশমাত্র আক্ষেপ প্রকাশ পাইতে দিল না।

35 Shares