চন্দ্রনাথ

চন্দ্রনাথ বলিল, আর ঐ মূর্ছাটা?

সরযূ হাসিল, ওটা কিছুই নয়।

চন্দ্রনাথ মনে মনে বলিল, যা হইবার হইয়াছে, এখন সর্বস্বান্ত হইয়াও তোমাকে আরোগ্য করিব।

সরযূ কহিল, তোমার কাছে একটি ভিক্ষা আছে, দেবে ত?

চাই কি?

নিজের কিছু চাই না। তবে, আমার যখন মৃত্যু-সংবাদ পাবে, তখন—এই সময় সে খোকাকে চন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসাইয়া দিয়া বলিল, তখন একবার এখানে এসে খোকাকে নিয়ে যেয়ো

চন্দ্রনাথ বিপুল আবেগে বিশ্বেশ্বরকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া মুখচুম্বন করিল।

এই সময় বাহির হইতে কৈলাসচন্দ্র ডাকিলেন, দাদা, বিশু!

বিশ্বেশ্বর পিতার ক্রোড় হইতে ছটফট করিয়া নামিয়া পড়িল,—দাদু যাই।

সরযূ উঠিয়া দাঁড়াইল,—ঐ এসেছেন।

কিছুক্ষণ পরে কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে ক্রোড়ে লইয়া প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলেন, চন্দ্রনাথও বাহিরে আসিল। কৈলাসচন্দ্র ইতিপূর্বে চন্দ্রনাথকে কখনও দেখেন নাই—দেখিলেও চিনতেন না, চাহিয়া রহিলেন। খোকা পরিচয় করিয়া দিল। হাত বাড়াইয়া বলিল, ওতা বাবা।

চন্দ্রনাথ প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। কৈলাসচন্দ্র আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, এস বাবা, এস।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

কিন্তু চন্দ্রনাথ যখন বৃদ্ধকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, কাল এদের নিয়ে যাব, তখন কৈলাসচন্দ্রের বক্ষ-পঞ্জরের মধ্যে এককালে শতাধিক কামান দাগার মত শব্দ করিয়া উঠিল! নিজে কি কহিলেন, নিজের কানে সে শব্দ পৌঁছিল না। কিন্তু চন্দ্রনাথ শুনিল, অস্ফুট ক্রন্দনের মত বহুদূর হইতে কে যেন কহিল, এমন সুখের কথা আর কি আছে!

সরযূ এ সংবাদ শুনিয়া আনন্দ প্রকাশ করিল না, তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। স্বামীর পদযুগল মস্তকে স্পর্শ করিয়া বলিল, পায়ের ধূলা দিয়ে হতভাগিনীকে এইখানেই রেখে যাও, আমাকে নিয়ে যেয়ো না।

চন্দ্রনাথ বলিল, কেন?

সরযূ জবাব দিতে পারিল না—কাঁদিতে লাগিল। বৃদ্ধ কৈলাসচন্দ্রের কাতর মুখখানি তাহার চোখের উপরে কেবলি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।

চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমি তোমার স্বামী, আমি যদি নিয়ে যাই, তোমার অনিচ্ছায় কিছু হবে না। আমি বিশুকে ছেড়ে থাকতে পারব না।

সরযূ দেখিল তাহার কিছুই বলিবার নাই।

পরদিন প্রাতঃকাল হইতে কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে সেদিনের মত কোলে তুলিয়া লইলেন। দাবার পুঁটুলি হাতে করিয়া শম্ভু মিশিরের বাড়ি আসিলেন। তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, মিশিরজী! আজ আমার সুখের দিন—বিশুদাদা আজ তার নিজের বাড়ি যাবে। বড় হয়েছে ভাই, কুঁড়েঘরে আর তাকে ধ’রে রাখা যায় না।

মিশিরজী আনন্দ প্রকাশ করিলেন।

কৈলাসচন্দ্র সতরঞ্চ পাতিয়া বল সাজাইয়া বলিলেন, আজ আমোদের দিনে এস, তোমাকে দু বাজি মাত ক’রে যাই।

খেলার প্রারম্ভেই কিন্তু কৈলাসচন্দ্র একে একে বল হারাইতে লাগিলেন। গজ চালিতে নৌকা, নৌকা চালিতে ঘোড়া, এমনি বড় গোলমাল হইতে লাগিল। মিশিরজী কহিল, বাবুজী, আজ তোমার মেজাজ চৈন নাই, বহুত গল্‌তি হোতা। ক্রমে এক বাজির পর আর এক বাজি কৈলাসচন্দ্র হারিয়া খেলা উঠাইয়া পুঁটুলি বাঁধিতে বসিলেন, কিন্তু লাল মন্ত্রীটা বাঁধিলেন না। বিশুর হাতে দিয়া বলিলেন, দাদা, মন্ত্রীটা তোমাকে দিলাম, আর কখনও চাব না। পথে আসিতে যাহার সহিত দেখা হইল, তাহাকেই এই সুখবরটা জানাইয়া দিলেন।

আজ সর্বকর্মেই বৃদ্ধের বড় উৎসাহ। কিন্তু কাজ করিতে কাজ পিছাইয়া পড়িতেছে। দাবাখেলার মত বড় ভুলচুক হইয়া যাইতেছে। যত বেলা পড়িয়া আসিতে লাগিল ভুলচুক ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল, সরযূ তাহা দেখিয়া গোপনে শতবার চক্ষু মুছিল। বৃদ্ধের কিন্তু মুখের উৎসাহ কমে নাই, এমন কি সরযূ যখন আড়ালে ডাকিয়া পদধূলি মাথায় লইয়া কাঁদিতে লাগিল, তখনও তিনি অশ্রুসংবরণ করিয়া হাসিয়া আশীর্বাদ করিলেন, মা আমার কাঁদিস নে। তোর বুড়ো জ্যাঠার আশীর্বাদে তুই রাজরানী হবি। আবার যদি কখনো আসিস, তোদের এই কুঁড়েঘরটিকে ভুলে যেন আর কোথাও থাকিস নে।

সরযূ আরও কাঁদিতে লাগিল, বুকের মাঝে শুধু সেই দিনের কথা কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতে লাগিল, যেদিন সে নিরাশ্রিতা পথের ভিখারিণী হইয়া কাশীতে আসিয়াছিল। আর আজ!

সরযূ বলিল, জ্যাঠামশাই, আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না যে—

কৈলাসচন্দ্র কহিলেন, আর ক’টা দিন মা? কিন্তু মনে মনে বলিলেন, এইবার ডাক পড়েছে, এতদিনে তপ্ত প্রাণটার জুড়োবার উপায় হয়েছে ।

সরযূ চোখ মুছিতে মুছিতে আকুলভাবে বলিল, আমার মায়া-দয়া নেই—

বৃদ্ধ বাধা দিয়া বলিলেন, ছি মা, ও-কথা ব’লো না—আমি তোমাকে চিনেচি।

রাত্রি দশটার সময়ে সকলে স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গাড়ির সময় ক্রমশঃ নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে।

বিশ্বেশ্বর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু লাল মন্ত্রীটা তখনও বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া ছিল। বৃদ্ধ নাড়াচাড়া করিয়া তাহাকে জাগাইয়া তুলিলেন। সদ্য নিদ্রোত্থিত হইয়া প্রথমে সে কাঁদিবার উপক্রম করিল, কিন্তু যখন তিনি মুখের কাছে মুখ আনিয়া ডাকিলেন, বিশু, দাদা! তখন সে হাসিয়া উঠিল, দাদু।

দাদাভাই আমার, কোথায় যাচ্চ?

বিশু বলিল, দাত্তি। তাহার পর মন্ত্রীটা দেখাইয়া কহিল, মন্‌তী।

কৈলাসচন্দ্র কহিলেন, হ্যাঁ দাদা! মন্ত্রী হারিয়ো না যেন।

এ গজদন্ত-নির্মিত রক্ত-রঞ্জিত পদার্থটা সম্বন্ধে কৈলাসচন্দ্র ইতিপূর্বে তাহাকে অনেকবার সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন, সেও ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হারাবো না—মন্‌তী!

0 Shares