চন্দ্রনাথ

ট্রেন আসিলে সরযূ পুনরায় তাঁহার পদধূলি মাথায় লইয়া গাড়িতে উঠিল। বৃদ্ধের আন্তরিক আশীর্বচন ওষ্ঠাধরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া ভিতরেই রহিয়া গেল।

ট্রেন ছাড়িবার আর বিলম্ব নাই দেখিয়া কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে চন্দ্রনাথের ক্রোড়ে দিয়া বলিলেন, দাদু!

দাদু!

মন্ত্রী!

সে মন্ত্রীটা দেখিয়া হাসিয়া বলিল, দাদু—মন্‌তী!

হারাস নে—

না।

এইবার বৃদ্ধের শুষ্কচক্ষে জল আসিয়া পড়িল। গাড়ি ছাড়িয়া দিলে তিনি সরযূর জানালার নিকট মুখ আনিয়া কহিলেন, মা, তবে যাই—আর একবার জোর করিয়া ডাকিলেন, ও দাদু—

গাড়ির শব্দে এবং লোকের কোলাহলে বিশ্বেশ্বর সে আহ্বান শুনিতে পাইল না। যতক্ষণ গাড়ির শেষ শব্দটুকু শুনা গেল, ততক্ষণ তিনি একপদও নড়িলেন না। তাহার পর ধীরে ধীরে ফিরিয়া গেলেন।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

বাড়ি পৌঁছিয়া চন্দ্রনাথের যেটুকু ভয় ছিল, খুড়ো মণিশঙ্করের কথায় তাহা উড়িয়া গেল। তিনি বলিলেন, চন্দ্রনাথ, পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, যে পাপ করেনি তার আবার প্রায়শ্চিত্তের কি প্রয়োজন? বধূমাতার কোন পাপ নেই, অনর্থক প্রায়শ্চিত্তের কথা তুলে তাঁর অবমাননা করো না। মণিশঙ্করের মুখে এরূপ কথা বড় নূতন শোনাইল। চন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিল। তিনি আবার কহিলেন, বুড়ো হয়ে অনেক দেখেছি যে, দোষ-লজ্জা প্রতি সংসারে আছে। মানুষের দীর্ঘ-জীবনে তাকে অনেক পা চলতে হয়, দীর্ঘ-পথটির কোথাও কাদা, কোথাও পিছল, কোথাও বা উঁচু-নীচু থাকে, তাই বাবা, লোকের পদস্খলন হয়; তারা কিন্তু সে কথা বলে না, শুধু পরের কথা বলে। পরের দোষ, পরের লজ্জার কথা চিৎকার ক’রে বলে, সে শুধু আপনার দোষটুকু গোপনে ঢেকে ফেলবার জন্যেই। তারা আশা করে, পরের গোলমালে নিজের লজ্জাটুকু চাপা পড়ে যাবে। চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া রহিল। মণিশঙ্কর একটু থামিয়া পুনর্বার কহিলেন, আর একটা নূতন কথা শিখেছি—শিখেছি যে, পরকে আপনার করা যায়; কিন্তু যে আপনার, তাকে কে কবে পর করতে পেরেছে? এতদিন আমি অন্ধ ছিলাম, কিন্তু বিশু আমার চোখ ফুটিয়ে দিয়েছে। তার পুণ্যে সব পবিত্র হয়েছে। আজ দ্বাদশী। পূর্ণিমার দিন তোমার বাড়িতে গ্রামসুদ্ধ লোকের নিমন্ত্রণ করেচি। তখন দাদা ছিলেন, কাজকর্ম সবই তিনি করতেন। আমি কখনও কিছু করতে পাইনি—তাই মনে করছি, বিশুর আবার নূতন করে অন্নপ্রাশন দেব।

চন্দ্রনাথ চিন্তা করিল, কিন্তু সমাজ?

মণিশঙ্কর হাসিলেন, বলিলেন, সমাজ আমি, সমাজ তুমি। এ গ্রামে আর কেউ নেই; যার অর্থ আছে, সেই সমাজপতি। আমি ইচ্ছা করলে তোমার জাত মারতে পারি, আর তুমি ইচ্ছা করলে আমার জাত মারতে পার। সমাজের জন্য ভেব না। আর একটা কথা বলি—এতদিন তা বলিনি, বোধ হয় কখনও বলতাম না, কিন্তু ভাবচি, তোমার কাছে একথা প্রকাশ করলে কোন ক্ষতি হবে না। তোমার রাখাল ভট্‌চায্যের কথা মনে হয়?

হয়। হরিদয়াল ঠাকুরের পত্রে পড়েছিলাম।

আমার পরিবারের যদি কিছু লজ্জার কথা থাকে, শুধু সেই প্রমাণ করতে পারত, কিন্তু সে আর কোন কথা প্রকাশ করবে না, আমি তাকে জেলে দিয়েছি। কিছুদিন হল সে খালাস হয়ে কোথায় চলে গেছে, আর কখনও এ দেশে পা বাড়াবে না।

মণিশঙ্কর তখন আনুপূর্বিক সমস্ত কথা বিবৃত করিলেন। সে সকল কাহিনী শুনিয়া চন্দ্রনাথের দুই চক্ষু বাষ্পাকুল হইয়া উঠিল।

তাহার পর পূর্ণিমার দিন খাওয়ানো-দাওয়ানো শেষ হইল। গ্রামের কেহই কোন কথা কহিল না। তাহারা মণীশঙ্করের ব্যবহার দেখিয়া বিশ্বাস করিল যে, একটা মিথ্যা অপবাদ রটনা হইয়াছিল,—হয় ত সে একটা জমিদারী চাল মাত্র!

হরকালী আলাদা রাঁধিয়া খাইলেন,—তাঁহারা এ গ্রামে আর বাস করিবেন না—বাড়ি যাইবেন। হরকালী বলিলেন, প্রাণ যায় সেও স্বীকার, কিন্তু ধর্মটাকে তিনি কিছুতেই ছাড়িতে পারিবেন না। ইহা সুখের কথাই হউক আর দুঃখের কথাই হউক, চন্দ্রনাথ তাঁহাদের পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে মাসিক একশত টাকা বরাদ্দ করিয়া দিয়াছে।

উৎসবের শেষে অনেক রাত্রে নাচ-গান বন্ধ হইলে ঘরে আসিয়া চন্দ্রনাথ দেখিল সর্ব অলঙ্কার-ভূষিতা রাজরাজেশ্বরীর মত নিদ্রিত পুত্র ক্রোড়ে লইয়া সরযূ স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিয়া নিশি জাগিয়া বসিয়া আছে।

আজ পূর্ণিমা।

চন্দ্রনাথ বলিল, ইস।

সরযূ মৃদু হাসিয়া বলিল, সই আজ কিছুতেই ছাড়লেন না।

বিংশ পরিচ্ছেদ

সে রাত্রে এক-পা এক-পা করিয়া বৃদ্ধ কৈলাসচন্দ্র বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। বাঁধান তুলসী-বেদীর উপর তখনও দীপটা জ্বলিতেছিল, তথাপি এ কি ভীষণ অন্ধকার! এইমাত্র সবাই ছিল, এখন আর কেহ নাই। শুধু মাটির প্রদীপটি সেই অবধি জ্বলিতেছে; তাহারও আয়ু ফুরাইয়া আসিয়াছে, এইবার নিবিয়া যাইবে। সরযূ এটি স্বহস্তে জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছিল।

শয্যায় আসিয়া তিনি শয়ন করিলেন। অবসন্ন চক্ষু দুইটি তন্দ্রায় জড়াইয়া আসিল। কিন্তু কানের কাছে সেই অবধি যেন কে মাঝে মাঝে ডাকিয়া উঠিতেছে, দাদু! স্বপ্ন দেখিলেন, রাজা ভরত তাঁহার বুকের মাঝখানটিতে মৃত্যূশয্যা পাতিয়া ক্ষীণ ওষ্ঠ কাঁপাইয়া বলিতেছে,—ফিরে আয়! ফিরে আয়!

সকালবেলায় শয্যায় উঠিয়া বসিলেন, বাহিরে আসিয়া অভ্যাসবশতঃ ডাকিলেন, বিশু! তাহার পর মনে পড়িল, বিশু নাই, তাহারা চলিয়া গিয়াছে।

দাবার পুঁটুলি হাতে লইয়া শম্ভু মিশিরের বাড়ি চলিলেন। ডাকিয়া বলিলেন, মিশিরজী, দাদাভাই আমার চলে গেছে।

0 Shares