চন্দ্রনাথ

রাত্রে শম্ভু মিশির কবিরাজ ডাকিয়া আনিল। কবিরাজ বাঙ্গালী—কৈলাসচন্দ্রের সহিত জানাশুনা ছিল। তাঁহার প্রশ্নের দুই-একটা উত্তর দিয়া কহিলেন, কবিরাজমশাই, দাদাভাই চিঠি লিখেচে, এই পড়ি শুনুন।

দাদাভায়ের সহিত কবিরাজ মহাশয়ের পরিচয় ছিল না। তিনি বলিলেন, কার পত্র?

দাদু—বিশু—লখীয়ার মা, আলোটা একবার ধর ত বাছা—

প্রদীপের সাহায্যে তিনি সবটুকু পড়িয়া শুনাইলেন। কবিরাজ শুনিলেন কিনা কৈলাসচন্দ্রের তাহাতে ভ্রূক্ষেপও নাই। সরযূর হাতের লেখা বিশুর চিঠি, বৃদ্ধের ইহাই সান্ত্বনা, ইহাই সুখ। কবিরাজ মহাশয় ঔষধ দিয়া প্রস্থান করিলে, কৈলাসচন্দ্র শম্ভু মিশিরকে ডাকিয়া বিশ্বেশ্বরের রূপ, গুণ, বুদ্ধি এ-সকলের আলোচনা করিতে লাগিলেন।

দুই সপ্তাহ অতীত হইল, কিন্তু জ্বর কমিল না; বৃদ্ধ তখন একজন পাড়ার ছেলেকে ডাকিয়া বিশুকে পত্র লিখাইলেন—মোট কথা এই যে, তিনি ভাল আছেন, তবে সম্প্রতি শরীরটা কিছু মন্দ হইয়াছে, কিন্তু ভাবনার কোন কারণ নাই।

কৈলাসখুড়ার প্রাণের আশা আর নাই শুনিয়া হরিদয়াল দেখিতে আসিলেন। দুই-একটা কথাবার্তার পর কৈলাসচন্দ্র বালিশের তলা হইতে সেই চিঠিখানি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া বলিলেন, বাবাজী, পড়।

পত্রখানা নিতান্ত মলিন হইয়াছে, দুই-এক জায়গায় ছিন্ন হইয়া গিয়াছে, ভাল পড়া যায় না। হরিদয়াল যাহা পারিলেন পড়িলেন। বলিলেন, সরযূর হাতের লেখা।

তার হাতের লেখা বটে, আমার দাদার চিঠি।

নীচে তার নাম আছে বটে!

বৃদ্ধ কথাটায় তেমন সন্তুষ্ট হইলেন না। বলিলেন, তার নাম, তার চিঠি, সরযূ কেবল লিখে দিয়েছে। সে যখন লিখতে শিখবে, তখন নিজের হাতেই লিখবে।

হরিদয়াল ঘাড় নাড়িলেন।

কৈলাসচন্দ্র উৎসাহের সহিত বলিতে লাগিলেন, পড়লে বাবাজী? বিশু আমার রাত্তিরে দাদু দাদু ব’লে কেঁদে ওঠে, সে ভুলতে পারে? এই সময় গণ্ড বাহিয়া দু’ ফোঁটা চোখের জল বালিশে আসিয়া পড়িল।

লখীয়ার মা নিকটে ছিল, সে দয়ালঠাকুরকে ইশারা করিয়া বাহিরে ডাকিয়া বলিল, ঠাকুর, যাও, তুমি থাকলে সারাদিন ঐ কথাই বলবে।

আর চার-পাঁচ দিন কাটিয়া গেল। অবস্থা নেহাত মন্দ হইয়াছে, শম্ভু মিশির আজকাল রাত্রিদিন থাকে, মাঝে কবিরাজ আসিয়া দেখিয়া যায়। আজ সমস্ত দিন ধরিয়া সংজ্ঞা ছিল না; সন্ধ্যার পর একটু জ্ঞান হইয়াছিল, তাহার পর অর্ধচেতনভাবে পড়িয়া ছিলেন। গভীর রাত্রে কথা কহিলেন, বিশু দাদা, আমার মন্ত্রীটা! এবার দে, নইলে মাত হয়ে যাব! শম্ভু মিশির কাছে আসিয়া বলিল, বাবুজী কি বলচে?

কৈলাসচন্দ্র তাহার পানে একবার চাহিলেন, ব্যস্তভাবে বালিশের তলায় একবার হাত দিলেন, যেন কি একটা হারাইয়া গিয়াছে, প্রয়োজনের সময় হাত বাড়াইয়া পাইতেছেন না। তাহার পর হতাশভাবে পাশ ফিরিয়া মৃদু মৃদু বলিলেন, বিশু, বিশ্বেশ্বর, মন্ত্রীটা একবার দে ভাই, মন্ত্রী হারিইয়ে আর কতক্ষণ খেলি বল্‌?

এ বিশ্বের দাবাখেলায় কৈলাসচন্দ্রের মন্ত্রী হারাইয়া গিয়াছে। বিশ্বপতির নিকট তাহাই যেন কাতরে ভিক্ষা চাহিতেছে। শম্ভু মিশির নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। লখীয়ার মা প্রদীপ মুখের সম্মুখে ধরিয়া দেখিল, বৃদ্ধের চক্ষু কপালে উঠিয়াছে, শুধু ওষ্ঠাধর তখনও যেন কাঁপিয়া কহিতেছে, বিশ্বেশ্বর! মন্ত্রী-হারা হয়ে আর কতক্ষণ খেলা যায়, দে ভাই, দে।

পরদিন দয়ালঠাকুর চন্দ্রনাথকে পত্র লিখিয়া দিলেন যে, গতরাত্রে কৈলাসচন্দ্রের মৃত্যু হইয়াছে।

(সমাপ্ত)

0 Shares