চন্দ্রনাথ

চন্দ্রনাথ বালিকা বধূকে আদর করিয়া কহিল, বাড়িঘর সব দেখলে? মনে ধরেচে ত?

সরযূ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া আঁচলে মুখ লুকাইয়া মাথা নাড়িল।

চন্দ্রনাথ স্ত্রীর মনের কথা বুঝিতে চাহে নাই; প্রত্যুত্তরে কণ্ঠস্বর শুনিতে চাহিয়াছিল, তাই দুই হাতে সরযূর মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া কহিল, কি বল, মনে ধরেছে ত?

লজ্জায় সরযূর মুখ আরক্ত হইয়া গেল, কিন্তু স্বামীর পুনঃ পুনঃ প্রশ্নে কোনরূপে সে বলিয়া ফেলিল, সব তোমার?

চন্দ্রনাথ হাসিয়া কথাটা একটু ফিরাইয়া বলিল, হাঁ, সব তোমার।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তাহার পর কতদিন অতিবাহিত হইয়া গেল। সরযূ বড় হইয়াছে। স্বামীকে সে কত যত্ন করিতে শিখিয়াছে। চন্দ্রনাথ বুঝিতে পারে যে, সে কথা কহিবার পূর্বেই সরযূ তাহার মনের কথা বুঝিয়া লয়। কিন্তু সে যদি শুধু দাসী হইত, তাহা হইলে সমস্ত বিশ্ব খুঁজিয়াও চন্দ্রনাথ এমন আর একটি দাসী পাইত না, কিন্তু শুধু দাসীর জন্যই কেহ বিবাহ করে না—স্ত্রীর নিকট আরও কিছুর আশা রাখে। মনে হয়, দাসীর আচরণের সহিত স্ত্রীর আচরণটি সর্বতোভাবে মিলিয়া না গেলেই ভাল হয়। সরযূর ব্যবহার বড় নিরীহ, বড় মধুর, কিন্তু দাম্পত্যের সুনিবিড়-পরিপূর্ণ সুখ কিছুতেই যেন গড়িয়া তুলিতে পারিল না। তাই এমন মিলনে, এত যত্ন-আদরেও উভয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব, একটা অন্তরাল কিছুতেই সরিতে চাহিল না। একদিন সে সরযূকে হঠাৎ বলিল, তুমি এত ভয়ে ভয়ে থাক কেন? আমি কি কোন দুর্ব্যবহার করি?

সরযূ মনে মনে ভাবিল, এ কথার উত্তর কি? তুমি নিজে জানো না? তাহার পর ভাবিল, তুমি দেবতা, কত উচ্চ, কত মহৎ,—আর আমি? সে তুমি আজও জানো না। তুমি আমার প্রতিপালক, আমি শুধু তোমার আশ্রিতা। তুমি দাতা, আমি ভিখারিণী।

তাহার সমস্ত হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, তাই ভালবাসা মাথা ঠেলিয়া উপরে উঠিতে পারে না,—অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত নিঃশব্দে ধীরে ধীরে হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশে লুকাইয়া বহিতে থাকে, উচ্ছৃঙ্খল হইতে পায় না—তেমনি অবিশ্রাম বহিতে লাগিল, কিন্তু চন্দ্রনাথ তাহার সন্ধান পাইল না—অতি বড় দুর্ভাগারা যেমন জীবনের মাঝে ভগবানকে খুঁজিয়া পায় না। কিন্তু আজ অকস্মাৎ উজ্জ্বল দীপালোকে যখন সে দেখিতে পাইল, পদ্মের মত ডাগর সরযূর চক্ষু দুটিতে অশ্রু ছাপাইয়া উঠিয়াছে, তখন কাতর হইয়া সহসা তাহাকে সে কাছে টানিয়া লইল। বুকের উপর মুখ লুটাইয়া পড়িল। চন্দ্রনাথ কহিল, থাক, ওসব কথায় আর কাজ নেই—বলিয়া দুই হাতে স্ত্রীর মুখ তুলিয়া ধরিল, মুদিত চক্ষের উপর সরযূ একটা তপ্ত-নিশ্বাস অনুভব করিল।

চন্দ্রনাথ কহিল, একবার চেয়ে দেখ দেখি—

সরযূর চোখের পাতা দুইটি আকুলভাবে পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিল, সে কিছুতেই চাহিতে পারিল না।

কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চন্দ্রনাথ কহিল, তোমার বড় ভয়, তাই চাইতে পারলে না সরযূ। কিন্তু পারলে ভাল হ’ত, না হয়, একটা কাজ ক’রো, আমার ঘুমন্ত মুখ ভাল করে চেয়ে দেখো—এ মুখে ভয় করবার মত কিছু নেই। বুকে শুয়ে আছ, ভিতরের কথাটা কি শুনতে পাও না? তাই বড় দুঃখ হয় সরযূ—আমাকে তুমি বুঝতেই পারলে না।

তবু সরযূ কথা কহিতে পারিল না, শুধু মনে মনে স্বামীর চরণে প্রণাম করিয়া কহিল, আমি পদাশ্রিতা দাসী, দাসীকে চিরদিন দাসীর মতই থাকিতে দিয়ো।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চন্দ্রনাথের মাতুলানী হরকালীর মনে আর তিলমাত্র সুখ রহিল না। ভগবান তাহাকে এ কি বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলিয়া দিলেন। এ সংসারটা কাহারো নিকট কণ্টকাকীর্ণ অরণ্যের মত বোধ হয়, তাহাদের চেষ্টা করিয়া এখানে একটা পথের সন্ধান করিতে হয়। কেহ পথ পায়, কেহ পায় না। অনেক দিন হইতে হরকালীও এই সংসার-কাননে একটা সংক্ষেপ-পথ খুঁজিতেছিল, চন্দ্রনাথের পিতার মৃত্যুতে একটা সুরাহাও হইয়াছিল। কিন্তু এই আকস্মিক বিবাহ, বধূ সরযূ, চন্দ্রনাথের অতিরিক্ত পত্নীপ্রেম, তাহার এই পাওয়া-পথের মুখটা একেবারে পাষাণ দিয়া যেন গাঁথিয়া দিল। হরকালীর একটি বছর পাঁচেকের বোনঝি পিতৃগৃহে বড় হইয়া আজ দশ বছরেরটি হইয়াছে, কিন্তু সে কথা যাক। নানা কারণে হরকালীর মনের সুখ-শান্তি অন্তর্হিত হইবার উপক্রম করিয়াছিল।

অবশ্য আজও সে-ই গৃহিণী, তাহার স্বামী কর্তা—এ সমস্ত তেমনিই আছে। আজ পর্যন্ত সরযূ তাহারই মুখ চাহিয়া থাকে, কোন অসন্তোষ বা অভিমান প্রকাশ করে না। দেখিলে মনে হয়, সে এই পরিবারভুক্ত একটি সামান্য পরিজন মাত্র। হরকালীর স্বামী এইটুকু দেখিয়াই খুশি হইয়া যেই বলিতে যান—বৌমা আমার যেন—, হরকালী চোখ রাঙ্গা করিয়া ধমক দিয়া বলিয়া উঠে, চুপ কর, চুপ কর। য বোঝ না, তাতে কথা কয়ো না। তোমার হাতে দেওয়ার চেয়ে বাপ-মা আমাকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিলে ছিল ভাল।

ব্রজকিশোর মুখ কালি করিয়া উঠিয়া যান।

হরকালীর বয়স প্রায় ত্রিশ হইতে চলিল, কিন্তু সরযূর আজও পঞ্চদশ উত্তীর্ণ হয় নাই,—তবু তাহার আসা অবধি দুই জনের মনে মনে যুদ্ধ বাধিয়াছে। প্রাণপণ করিয়াও হরকালী জয়ী হইতে পারে না। একফোঁটা মেয়ের শক্তি দেখিয়া হরকালী মনে মনে অবাক হয়। বাহিরের লোক এ কথা জানে না যে, এই অন্তর-যুদ্ধে সরযূ ডিক্রি পাইয়াছে, কিন্তু তাহা জারি করে নাই। নিজের ডিক্রি নিজে তামাদি করিয়া বিজিত অংশ তাহাকেই সে ফিরাইয়া দিয়াছে এবং এখানেই হরকালীর একেবারে হার হইয়াছে।

0 Shares