চন্দ্রনাথ

দয়ালঠাকুর প্রায় প্রহার করিতে উদ্যত হইলেন, জান বৈ কি! চল্‌ ব্যাটা, এখনি তোকে পুলিশে দেব।

লোকটা ঈষৎ হাসিয়া এরূপ ভাব প্রকাশ করিল, যেন পুলিশের নিকট যাইতে তাহার বিশেষ আপত্তি নাই। কহিল, এখনই দেবে?

দয়ালঠাকুর ধাক্কা দিয়া বলিলেন, এখনি।

লোকটা ধাক্কা সামলাইয়া স্থির হইয়া গম্ভীরভাবে বলিল, ঠাকুর, একেবারে অত বিক্রম প্রকাশ করো না, পুলিশে দেবে কি থানায় দেবে, একটু বিলন্ব ক’রে দিয়ো। আমি তোমাকে কাশী ছাড়া করতে পারি, জান?

দয়ালঠাকুর উন্মত্তের মত চীৎকার করিয়া উঠিলেন, ব্যাটা পাজী, আজ আমার চল্লিশ বছর কাশীবাস হ’ল, এখন তুমি কাশী-ছাড়া করবে?

তিনি ভাবিয়াছিলেন, লোকটা তাঁহাকে গুন্ডার ভয় দেখাইতেছে। অনেকে এ কথায় হয়ত ভয় পাইত, কিন্তু এই দীর্ঘকালের কাশীবাসে দয়ালঠাকুরের এ ভয় ছিল না। বলিলেন, ব্যাটা, আমার কাছে গুন্ডাগিরি!

গুন্ডাগিরি নয় ঠাকুর, গুন্ডাগিরি নয়। পুলিশে নিয়ে চল। সেখানেই সব কথা প্রকাশ করব।

কোন্‌ কথা প্রকাশ করবে?

যা জানি। যাতে তুমি কাশী ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না। যাতে সমস্ত দেশের লোক শুনবে যে, তুমি জাতিচ্যুত অব্রাহ্মণ।

আমি অব্রাহ্মণ!

রাগ করো না, ঠাকুর। তুমি জাতিচ্যুত । শুধু তাই নয়। তোমার কাছে যত ভদ্রসন্তান বিশ্বাস ক’রে এসেছে, এই তিন বৎসরের মধ্যে যত লোককে তুমি অন্ন বেচেছ, সকলেরই জাত গেছে। সকলকেই আমি সে কথা বলবো।

দয়ালঠাকুর ভয় পাইলেন। ভয়ের যথার্থ কারণ হৃদয়ঙ্গম হইবার পূর্বেই উদ্ধত কণ্ঠস্বর নরম হইয়া আসিল। তথাপি বলিলেন, আমি লোকের জাত মেরেছি?

তাই। আর প্রমাণ করবার ভারও আমার।

ঠাকুর নরম হইয়া কণ্ঠস্বর কিছু কম করিয়া বলিলেন, কথাটা কি, ভেঙ্গে বল দেখি বাপু?

লোকটা মৃদু হাসিয়া কহিল, একাই শুনবে, না, দু’-দশজন লোক ডাকবে। আমি বলি, দু’-চারজন লোক ডাক। দু’-চারজন পাড়াপড়শীর সামনে কথাটা শোনাবে ভাল।

দয়ালঠাকুর তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, রাগ করো না বাপু, আমি হঠাৎ বড় অন্যায় কাজ করেছি। কিছু মনে করো না। এস, ঘরে চল।

দুই জনে একটা ঘরে আসিয়া বসিলে দয়ালঠাকুর কহিলেন, তার পর?

সে কহিল, সুলোচনা—যার হাতে আপনার অন্ন প্রস্তুত হয়, তাকে কোথায় পেলেন?

এইখানেই পেয়েছি। দুঃখীর কন্যা, তাই আশ্রয় দিয়েছি।

টাকাওয়ালা লোককে আশ্রয় দিয়েছেন, এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু সে কি জাত, তার অনুসন্ধান করেছেন কি?

দয়ালঠাকুরের সমস্ত মুখমণ্ডল একেবারে বিবর্ণ হইয়া গেল। তিনি বলিলেন, ব্রাহ্মণ-কন্যা, বিধবা, শুদ্ধাচারিণী, তার হাতে খেতে দোষ কি?

ব্রাহ্মণ-কন্যা এবং বিধবা, এ কথা সত্যি, কেউ যদি কুলত্যাগ ক’রে চ’লে যায়, তাকেও কি শুদ্ধাচারিণী বলা চলে? না, তার হাতে খাওয়া যায়?

দয়ালঠাকুর জিভ কাটিয়া বলিলেন, শিব! শিব! তা কি খাওয়া যায়!

তবে তাই! পনরো-ষোল বৎসর পূর্বে সুলোচনা তিন বছরের একটি মেয়ে নিয়ে গৃহত্যাগ করে, এবং তাকেই আশ্রয় দিয়ে আপনি নিজের এবং আর পাঁচজনের সর্বনাশ করেছেন।

প্রমাণ?

প্রমাণ আছে বৈ কি! তার জন্য ভাববেন না । যাঁর সঙ্গে কুলত্যাগ করেন, সেই অসীম প্রেমাস্পদ রাখাল ভট্‌চায এখনো বেঁচে আছেন।

দয়াল লোকটার মুখের পানে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন। মনে হইল যেন ইহারই নাম রাখাল। বলিলেন, তুমি কি ব্রাহ্মণ?

লোকটা মলিন উড়ানির ভিতর হইতে অধিকতর মলিন ছিন্ন-বিছিন্ন যজ্ঞোপবীত বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, না, না, গোয়ালা!

দয়াল একটুখানি সরিয়া বসিয়া বলিলেন, তোমাকে দেখে তো চামার ব’লে মনে হয়েছিল। যা হোক, নমস্কার।

সে ব্যক্তি রাগ করিল না। বলিল, নমস্কার। আপনার অনুমান মিথ্যা নয়, আমাকে চামার বলাও চলে, মুসলমান খ্রীষ্টান বলাও চলে। আমি জাত মানিনে—আমি পরমহংস।

তুমি অতি পাষণ্ড।

সে বলিল, সে কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন দেখচি না, কেননা, ইতিপূর্বে অনেকেই অনুগ্রহ ক’রে ও কথা বলেছেন। কি ছিলাম, কি হয়েচি, তা এখনো বুঝি। কিন্তু আমিই রাখালদাস।

দয়ালের মুখখানি অপরিসীম ক্রোধে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; কোনমতে মনের ভাব দমন করিয়া তিনি বলিলেন, এখন কি করতে চাও? সুলোচনাকে নিয়ে যাবে?

আজ্ঞে না। তাতে আপনার খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হবে, আমি অত নরাধম নই।

প্রাণের দায়ে দয়াল এ পরিহাসটাও পরিপাক করিলেন। তারপব বলিলেন, তবে কি চাও? আবার এসেচ কেন?

টাকা চাই। দারুণ অর্থাভাব, তাই আপাততঃ এসেছি। হাজার-দুই পেলেই নিঃশব্দে চলে যাব, জানাতে এসেছি।

এত টাকা তোমায় কে দেবে?

যার গরজ। আপনি দেবেন—সুলোচনার জামাই দেবে—সে বড়লোক।

দয়াল তাহার স্পর্ধা দেখিয়া মনে মনে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। কিন্ত সে অতিশয় ধূর্ত এবং কৌশলী, তাহাও বুঝিলেন। বলিলেন, বাপু আমি দরিদ্র, অত টাকা কখনও চোখে দেখিনি।

তবে সুলোচনার জামাই দিতে পারে, সে কথা ঠিক। কিন্তু সে দেবে না। তাকে চেন না, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে দু’হাজার ত ঢের দূরের কথা—দুটো পয়সাও আদায় করতে পাববে না। তুমি যে বুদ্ধিমান লোক তা টের পেয়েছি, কিন্তু সে আরও বুদ্ধিমান। বরং আর কোন ফন্দি দেখ—এ খাটবে না।

রাখাল দয়ালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চাহিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিল। বলিল, সে ভাবনা আমার। দেখা যাক, যত্নে কৃতে যদি—

দয়াল তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, থাক বাবা, দেবভাষাটাকে আর অপবিত্র করো না।

0 Shares