দিবাকর মুখের উপর হইতে বইখানা না তুলিয়াই কহিল, না, ভারী মাথা ধরেচে।
কিরণময়ী হাসিয়া বলিল, তা হলে ত বেশ চিকিৎসা হচ্চে। মাথার ওপর আলো জ্বেলে রাখলে কি মাথা ছাড়ে নাকি ঠাকুরপো?
দিবাকর বলিল, বইটা কালই ফিরিয়ে দিতে হবে, তাই শেষ করে ফেলচি।
কিরণময়ী কহিল, চোখ বুজে আয়েষাকে ভাবলে বই শেষ হবে না ভাই, চোখ চেয়ে পড়তে হবে। তা না হয় খেয়েদেয়েই শেষ করো—এখন চল, খাবার জুড়িয়ে যাচ্চে।
দিবাকরের উঠিতে ইচ্ছা ছিল না; সে শ্রান্ত অনুনয়ের সুরে কহিল, এখন থাক বৌদি। মাসীমা আসুন, তার পরে খাব।
কিরণময়ী কহিল, তাঁরা কতক্ষণে ফিরবেন তার ঠিক কি ঠাকুরপো? আজ আমার নিজের শরীরও ভাল নয়। মনে করছি, তাঁর ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে একটু শোব। ওঠো, তোমাকে খাইয়ে দিই গে, বলিয়া সে কাছে আসিয়া বইখানা দিবাকরের মুখের উপর হইতে তুলিয়া লইল।
অদূরে দিবাকরের লোহার তোরঙ্গটা ছিল। কিরণময়ী ফিরিয়া আসিয়া তাহার উপর উপবেশন করিয়া পুনরায় তাড়া দিয়া কহিল, ওঠো না গো।
আমার উঠতে ইচ্ছে করে না বৌদি। তার চেয়ে বরং একটা গল্প কর আমি শুনি।
শুধু গল্প শুনে ত পেট ভরে না ঠাকুরপো, সময়ে খেতেও হয়। কি বল?
দিবাকর ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আচ্ছা বৌদি, আমার নাওয়া-খাওয়া-শোয়া নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?
কিরণময়ী হাসিমুখে কহিল, কেন জান না?
না বললে কেমন করে জানব?
এটি তোমার মিছে কথা ভাই। না বললেও জানা যায়, আর তুমিও ঠিক জান।
দিবাকরের মুখচোখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিয়া সহসা কেমন যেন একটা উদাস করুণ-সুরে কথা কহিল। বলিল, আচ্ছা বৌদি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
একটা কেন ভাই, এক শ’টা করো। কিন্তু আগে খেয়েদেয়ে আমাকে ছুটি দাও—তার পরে না হয় সারারাত ধরে তোমার কথার জবাব দেব। কেমন রাজী? বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।
দিবাকর এই পরিহাসের একটা পাল্টা জবাব দিবার প্রয়াস করিয়া কৃত্রিম সহানুভূতির স্বরে বলিল, বেশ ত বৌদি! তুমি বুঝি ঐ শক্ত বাক্সটার উপর সমস্ত রাত বসে আমার কথার জবাব দেবে?
কিরণময়ী মুচকিয়া হাসিল। কহিল, ঐটার ওপর বসলে যদি তোমার ব্যথা লাগে ঠাকুরপো, না হয় তোমার নরম বিছানার উপরেই উঠে বসব। কেমন? তা হলে ত আর ক্ষোভ থাকবে না।
আবার দিবাকরের কর্ণমূল পর্যন্ত আরক্ত হইয়া উঠিল। সে লজ্জায় পাশ ফিরিয়া শুইল।
কিরণময়ী উঠিয়া আসিয়া বলিল, নাও ওঠো—আমাকে ছুটি দাও, আর পাশ ফিরে শুতে হবে না।
রান্নাঘর হইতে ঝির গলা শুনা গেল—আমি এখানে থেকে শুনতে পাচ্চি বৌমা, তুমি পাও না গা? মা যে নীচে ডাকাডাকি কচ্চেন।
কিরণময়ী ফিরিয়া আসিয়া আবার সেই তোরঙ্গটার উপর বসিল। রাগ করিয়া বলিল, আস্পর্ধা ত কম নয় ঝি? আমি গিয়ে দোর খুলে দেব, তুই পারিস নে?
আমার হাত জোড়া, তাই বলা বৌমা! বলিয়া ঝি বকিতে বকিতে দুমদুম করিয়া নীচে নামিয়া গেল।
দ্বার খুলিতেই অঘোরময়ী বকিয়া উঠিলেন, তোরা কি সব কানের মাতা খেয়েচিস ঝি? এ যে আধ-ঘণ্টা ধরে কড়া নাড়চি আমরা।
এবার ঝিও গর্জিয়া উঠিল, কানের মাতা চোখের মাতা না খেলে কি আর তোমার বাড়িতে কেউ চাকরি করতে আসে মা? এবার চোখকানবালা কাউকে রাখো গে মা, আমাকে জবাব দাও। রান্নাঘর থেকে আমি সদর-দরজার ডাক শুনতে পাব না!
অঘোরময়ী নরম হইয়া বলিলেন, বৌমা কোথায়?
ঝি অস্ফুট ঝঙ্কারে কহিল, দেওরকে নিয়ে সারাদিন সোহাগ হচ্চে—আর কি হবে! ঐ যে দোর খুলে দিতে বলেছিলুম বলে আমায় চোখ রাঙ্গিয়ে আস্পর্ধা দেখিয়ে দিলে! ও মা! এ যে বড়বাবু! বলিয়া ঝি অপ্রতিভ হইয়া পাশ কাটাইয়া দাঁড়াইল।
অঘোরময়ী মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, উপীন, আয় বাবা ওপরে আয়।
চল মাসীমা যাচ্ছি, বলিয়া উপেন্দ্র অঘোরময়ীর পিছনে পিছনে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতে লাগিল। কিন্তু সমস্ত কথাই তাহার কানে গিয়াছিল।
উপরে আসিয়া অঘোরময়ী তীব্রকণ্ঠে ডাক দিলেন, কোথায় আছ একবার বার হও না বৌমা? উপীন এসেছে যে—
অন্ধকার ঘরের ভিতর বসিয়া কিরণময়ীর বুকের ভেতরটা ধড়াস করিয়া উঠিল এবং বিছানার মধ্যে দিবাকরের সর্বাঙ্গ শিথিল হিম হইয়া গেল।
অঘোরময়ী পুনরায় ডাক দিলেন, গেলে কোথায়? একখানা মাদুর-টাদুর পেতে দাও না বৌমা—উপীন দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি গো?
কিরণময়ী বাহিরে আসিয়া বারান্দায় একখানা মাদুর পাতিয়া দিল। তাহার মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না।
উপেন্দ্র কাছে আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, ভাল আছেন বৌঠান?
কিরণময়ী নিজেকে সামলাইয়া ফেলিল। ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হ্যাঁ। তুমি কেমন ঠাকুরপো? বৌ ভাল আছে? খবর না দিয়ে এমন হঠাৎ যে? কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনিয়া উপেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। গলার মধ্যে কোথাও যেন লেশমাত্র রস নাই, এমনি শুষ্ক, এমনি নীরস।
উপেন্দ্র কহিল, মক্কেলের পয়সায় আসা বৌঠান, আবার কাল বিকেলেই ফিরে যেতে হবে। কালীঘাটের দরকার সেরে বেরিয়েই দেখি মাসীমা। সেই পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরছি। দিবাকরের খবর কি বলুন ত? সে না দেয় চিঠিপত্র, না দেয় একটা খবর। বেরিয়েছে বুঝি?