চরিত্রহীন

দিবাকর বলিল, ব্রাহ্মণ।

তৎক্ষণাৎ লোকটি দুই হস্ত প্রসারিত করিয়া দিবাকরের জুতার উপর হইতেই পদধূলি সংগ্রহ করিয়া লইয়া জিহ্বায়, কণ্ঠে ও মস্তকে স্থাপন করিয়া বলিল, ভাবছিলাম এ কটা দিন বুঝি বা বৃথায় যায়। মশায় আছেন কোথায়?

দিবাকর অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া উপরে দেখাইয়া দিলে, সে বলিল, কেবিনে আছেন? তা যেখানেই থাকুন দিনান্তে একটিবার পদধূলি থেকে বঞ্চিত করবেন না। যাবেন কোথায়, রেঙ্গুনে?

দিবাকর মাথা নাড়িয়া বলিল, না আরাকানে।

আরাকানে ত আমিও থাকি। আজ বিশ বৎসর ওখানে আছি, মহাশয়কে ত কখন দেখিনি। এই প্রথম যাচ্ছেন? সেখানে কেউ আত্মীয় আছেন বুঝি? নেই? তা হোক— কিছু চিন্তা করবেন না। মশায়ের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে আমি ওখানকার একজন বাড়িওয়ালা, অনেকগুলো ঘর আমার খালি পড়ে আছে। তা যাবেন আপনি—আমার সঙ্গেই। পার্শ্বোপবিষ্টা স্ত্রীলোকটিকে দেখাইয়া বলিল, ইনি বাড়িউলী।

বাড়িউলী এতক্ষণ অনিমেষ-দৃষ্টিতে দিবাকরের পানে চাহিয়াছিল। অত্যন্ত ভারী ও মোটা গলায় জিজ্ঞাসা করিল, আপনার পরিবার সঙ্গে আছেন বুঝি?

দিবাকর মুখ রাঙ্গা করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কোনমতে জানাইয়া দিল, আছেন। স্ত্রীলোকটির কথা বাঁকা বাঁকা, কপালে উলকি, সীমন্তে মস্ত চওড়া সিন্দূরের দাগ, নাকে নথ এবং দুই কানে বিশ-ত্রিশটা মাকড়ি। মাথায় যে একটুখানি আঁচল দেওয়া ছিল, উৎসাহের আবেগে তাহাও নামিয়া পড়িল। কহিল, ভালই হলো। আরাকান বড় মন্দ জায়গা মশায়,—মগের দেশ। কিন্তু আমার বাড়িতে কারো দাঁত ফোটাবার জো নেই—আমি তেমনি বাড়িউলী নই। কামিনীকে ভয় করে না এমন লোক ওদেশে নেই। থাকবেন আমার বাড়িতেই, কোন ভয় নেই। ভাড়া পাঁচ টাকা করে, তা দেবেন আপনি চার টাকা করেই,—হাঁ বাড়িআলা, তোমাদের বাংশালে একটা কাজ জুটবে না?

বাড়িআলা একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, তা—তা জুটবে বৈ কি!

দিবাকর প্রশ্ন করিল, মশায়ের নাম—

হরিশ ভট্টাচায্যি! না, না, ও করবেন না—অপরাধ হবে। আমি ব্রাহ্মণ নই, কৈবর্ত। একটু শাস্তর-টাস্তর জানা আছে বলে লোকে আদর করে ভট্‌চায বলে ডাকে। ত্রিকণ্ঠি মালা ধারণ করেছি, মাছ-মাংস পরিত্যাগ করেছি,—আর কেন মশায়, ঢের ত করে দেখলুম; এখন প্রায় দু’হাজার আড়াই হাজার খরচ করে চার ধামে ঘুরে এলুম বাড়িতেও বছর-চারেক মাকে আনলুম,—আর কেন! তাই বাড়িউলীকে মাঝে মাঝে বলি, বাড়িউলী আরাকানে যা-কিছু আছে বিক্রি সিক্রি করে কোথাও একটা তীর্থধামে গিয়ে থাকি চল। বলিয়া লোকটা উদাসমুখে উপরের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। বাড়িউলীও তাহার স্বাভাবিক মোটা গলায় প্রত্যুত্তর করিল, আমিও তাই বলি। কাঁচা-বয়সে অদিষ্টের ফেরে যা করেছি, তা ত করেইছি—সে কিছু আর আমার গায়ে লেখা নেই—আমিও বলি, বাড়িআলা, আর নয়, এইবার যাই চল। বলিয়া সেও ঊর্ধ্বনেত্রে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। দিবাকর পাকা লোক নয়, এই সমস্ত ইতিহাসের নিগূঢ় তত্ত্ব কিছুতেই হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

বাড়িউলী কথা কহিল। বলিল, হাঁ বাড়িআলা, এইবার তবে চিঁড়েগুলি ভিজিয়ে দিই?

বাড়িআলার ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেল। ধীরে ধীরে বলিল, দাও।

সংসার অনভিজ্ঞ দিবাকর এ ইঙ্গিতের তাৎপর্যটা এখন বুঝিতে পারিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি এখন যাই,—আবার আসব তখন।

হরিশের নিকট হইতে বিদায় লইয়া দিবাকর অস্নাত, অভুক্ত অবস্থায় ডেকের একখানা আরাম-চৌকির উপরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। কখন যে জাহাজ নদীর ঘোলা জল পার হইয়া গেল, কখন যে অগাধ কৃষ্ণবর্ণ লবণাম্বুরাশির মাঝখানে ভাসিয়া আসিল, তাহা জানিতেও পারিল না। অস্ফুট-কোলাহলে ঘুম ভাঙ্গিয়া সম্মুখে দেখিল রাঙ্গা-সূর্য অস্ত যাইতেছে। বহু লোক তর্ক-বিতর্ক করিতে করিতে তাহাই দেখিতেছে। যে সূর্যাস্তের বিবরণ সে ইতিপূর্বে ইংরাজী বাংলা অনেক পুস্তকে অনেকবার পড়িয়াছে, এই সেই সূর্যাস্ত! এই সেই সত্যকার সমুদ্র! চতুর্দিকে চাহিয়া একবার সে অনন্ত জলরাশি দেখিয়া লইল এবং পরক্ষণে অস্তগমোন্মুখ সূর্যদেবকে নমস্কার করিতেই তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল। সূর্য অস্ত গেল, সে চাহিয়া রহিল, আকাশ ম্লান হইয়া আসিল সে চাহিয়া রহিল, সন্ধ্যার অন্ধকার নামিয়া আসিতে লাগিল সে চাহিয়া রহিল, ক্রমে আকাশ ও জল গাঢ় কৃষ্ণমূর্তি ধারণ করিল, তবুও দিবাকর তেমনি করিয়াই চেয়ারে পড়িয়া নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

নৈশ শীতল বায়ু হুহু করিয়া বহিয়া যাইতেছে, উপর ডেক প্রায় জনশূন্য, মাথার উপরে কৄষ্ণপক্ষের গভীর কালো আকাশ, নীচে সাগরের তেমনি গভীর কালো জল, তাহারি মাঝখানে দিবাকর নিজের অন্তরের সুগভীর কালিমাকে নিমজ্জিত করিয়া দিয়া কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি বোধ করিতেছিল, এমনি সময়ে হঠাৎ কাহার কোমল হস্তস্পর্শে তাহার চমক ভাঙ্গিল। ফিরিয়া দেখিল, কিরণময়ী।

কিরণময়ী বলিল, কি হচ্চে ঠাকুরপো! তুমি কি মৃত্যু পণ করে অনশন-ব্রত নিয়েচ?

দিবাকর জবাব দিল না, চুপ করিয়া রহিল।

কিরণময়ী ক্ষণকাল মাত্র উত্তরের অপেক্ষা করিয়া, ঘরে এস, বলিয়া জোর করিয়া তাহাকে কেবিনের মধ্যে টানিয়া আনিল এবং মেঝের উপরে পাতা শয্যার উপর বসাইয়া দিয়া কহিল, কিছুই যদি না বোঝ, এটা অন্ততঃ ত বুঝতে পারচ যে, শত কান্নাকাটিতেও জাহাজ তোমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। না খেয়ে শুকিয়ে মরলেও না, সাগরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেও না। আরাকানে তোমাকে যেতেই হবে। তবে কেন মিছে নিজে শুকিয়ে আমাকে শুকোচ্চ? যা দিই, যা পার খাও, তারপরে জাহাজ যখন আরাকানে পৌছবে, যেখানে খুশী নেবে যেয়ো, যখন খুশী ফিরে এসো—তোমার দিব্যি করে বলচি ঠাকুরপো, আমি বাধা দেব না। বলিতে বলিতেই কিরণময়ীর কণ্ঠস্বর উগ্র এবং ক্ষুৎপিপাসাতুর দুই চক্ষু আগুনের মত দীপ্ত হইয়া উঠিল।

0 Shares