চরিত্রহীন

কিন্তু যে-মুহূর্তে দিবাকর তাহার রুক্ষস্বর ও তীব্রতর প্রশ্নে ভিতরের ঈর্ষার জ্বালাটা একেবারে অত্যন্ত সুগোচর করিয়া ফেলিল, সেই মুহূর্তেই কিরণময়ীর অন্তরের নিভৃত বেদনাটা হর্ষে হিল্লোলিত হইয়া উঠিল। এই পুলকের আরও একটা বড় কারণ ছিল। ইতিপূর্বে অপরিণত-বুদ্ধি এই তরুণ যুবকটি তাহার প্রথম যৌবনের সৌন্দর্য-তৃষ্ণায় এই আশ্চর্য নারীর অলৌকিক রূপের পানে যখন তিল-তিল করিয়া আকৃষ্ট হইতেছিল, কিরণময়ী তখন দেখিয়াও দেখে নাই, জানিয়াও ভ্রূক্ষেপ করে নাই। কেমন করিয়া সে মধুচক্র গড়িয়া উঠিতেছিল, কোথায় তাহার মধু সঞ্চিত হইতেছিল, নিরতিশয় অবহেলায় এদিকে সে দৃষ্টিপাত করে নাই। কিন্তু, আজ যখন খোঁচা খাইয়া অকস্মাৎ মধু ঝরিয়া পড়িল, তখন, এই নির্বাসনে যে-লোক তাহার একমাত্র অবলম্বন, তাহারই মধুচক্রের সযত্ন-সঞ্চিত প্রচ্ছন্ন মধু-ভাণ্ডারের প্রতি কিরণময়ী তাহার একান্ত সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া রাখিল। হাসিয়া বলিল, কার কাছে কিভাবে থাকব, সে খবর শুনে তোমার লাভ কি ঠাকুরপো? যখন ফিরেই যাবে, তখন এ অনাবশ্যক কৌতূহলের কোন সার্থকতাই নেই।

দিবাকর কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিল। পরে কহিল, ফিরে যাবই এ কথা ত আমি একবারো বলিনি। ওটা তোমারই মুখের কথা—আমার নয়।

কিরণময়ী বলিল, সে ঠিক। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে তোমার মনের কথাই বার হয়ে এসেছে,—বলিয়াই সে তীব্র প্রতিবাদ প্রত্যাশা করিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। কিন্তু প্রতিবাদ আসিল না। কিরণময়ী তাহাকে ভাবিবার সময় দিয়া ধৈর্য ধরিয়া রহিল। বহুক্ষণ কাটিয়া গেল—বাহিরে ঝড়-জলের অশ্রান্ত আক্রমণে জাহাজের মেরুমজ্জা কাঁপিতে লাগিল, খালাসীদের অস্পষ্ট কোলাহল মাঝে মাঝে স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল, কিরণময়ীর ধৈর্যের বাঁধও ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম করিল, কিন্তু এ ক্ষুদ্র কাঠের ঘরটির নিস্তব্ধতা অক্ষুণ্ণ হইয়াই রহিল।

দিবাকর প্রতিবাদ করিবে না ইহাতে কিরণময়ীর যখন আর লেশমাত্র সংশয় রহিল না, তখন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আস্তে আস্তে বলিল, তবে কি তোমার ফিরে যাওয়াই স্থির হলো?

দিবাকর বলিল, না।

কিরণময়ী আর কোন প্রশ্ন করিল না।

পরিচ্ছেদ – ছত্রিশ

সেই রাত্রেই ঝড়জল কমিয়া গেল। সারাদিন অবিশ্রাম মাতামাতি করিয়া মত্ত সিন্ধু ভোরের দিকে শান্ত হইয়া আসিল। কিন্তু উপরের আকাশ প্রসন্ন হইল না—মুখ ভারী করিয়া রহিল।

সকালে ক্ষণকালের জন্য সূর্যোদয় হইল বটে, কিন্তু সূর্যদেব এই জাহাজের ভয়ার্ত অর্ধমৃত যাত্রীদিগকে বাস্তবিক সান্ত্বনা দিয়া গেলেন, কিংবা চোখ রাঙ্গাইয়া অন্তর্ধান হইলেন, নিশ্চিত বুঝা গেল না।

এমনি সময়ে দিবাকর বাহিরে আসিয়া একটা ক্যাম্বিসের আরাম-চৌকির উপর কাত হইয়া শুইয়া পড়িল। কি জানি কেন, আত্মগ্লানির তুষানল আজ তাহাকে আর তেমন করিয়া দগ্ধও করিতেছিল না। লজ্জার বারিধিও আজ তত দুস্তর বোধ হইল না—কোথায় যেন নীল রঙের গাছপালায় ঘেরা একটা অস্পষ্ট কূল ঝাপসা হইয়া চোখে পড়িতে লাগিল। বুকের অসহ্য বোঝাটা এইভাবে যখন হালকা হইয়া আসিয়াছে, তখন স্থির হইয়া বসিয়া দিবাকর আর একবার কিরণময়ীর তর্কটার উপরে নিজের প্রবৃত্তির দাগা বুলাইয়া লইতে প্রবৃত্ত হইল। কাল রাত্রে কিরণময়ী এই বলিয়া তর্ক করিয়াছিল যে, আমরা যথার্থ অন্যায় তখনই করি, যখন কাহাকেও তাহার ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করি! সুতরাং, কোনো কাজে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে ইহাই দেখা প্রয়োজন যে, কাহারো সত্যিকার অধিকারে হাত দিতেছি কি না। আবার এ অধিকার বাহিরের দিকে যেমন, ভিতরের দিকেও ঠিক তেমনি। নিজের উপরেও নিজের একটা সত্য অধিকার আছে। নিজের বলিয়া সে কাহারো চেয়ে তুচ্ছ নয়। সে অধিকারেও বাহিরের কাহারো হস্তক্ষেপ সহ্য করা নিজের উপরে অন্যায় করা। এই আমার কথা।

ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া সে আরও বলিয়াছিল, আমরা চুরি, ডাকাতি প্রভৃতি করিয়া যেমন পরের অধিকারে হাত দিয়া অন্যায় করি, মাতালকে পয়সা যোগাইয়াও ঠিক তাই করি। কেননা, সেখানে তাহার ভাল থাকিবার অধিকারে হাত দিই।

দিবাকর চুপ করিয়া শুনিতেছিল দেখিয়া কিরণময়ী পুনরায় কহিয়াছিল, যদিও সামাজিক লোকের এই অনধিকার অত্যন্ত ব্যাপক এবং কোথায় ইহার সীমারেখা, কোথায় পা দিলে অনধিকার প্রবেশ হবে না, এই নিয়ে সংসারে অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক মতভেদ, তবুও সীমা যে একটা আছেই সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই। এই সীমা অতিক্রম করবার ক্ষমতা কারও নেই, সমাজেরও না। সমাজ এই সীমা অতিক্রম করে শুধু যে পরকেই নষ্ট করে, তা নয়, নিজেকেও দুর্বল করে—ধ্বংস করে। তোমার এতটা মন ভারী করে থাকবার প্রয়োজন হতো না ঠাকুরপো, যদি একবার এই কথাটিই ভেবে দেখতে যে, আমাকে বাড়ির বাইরে এনে কারো সত্যিকার অধিকারে পা দিয়েছ কি না। আমি বিধবা, আমার উপর কারো ন্যায়সঙ্গত দাবী নেই, তুমিও অবিবাহিত, তোমার হৃদয়ের উপরেও কারো অধিকার নেই। অতএব, আমাকে ভালবেসে তুমি অন্যায় কিছুই করনি, এ কথাটা বোঝা ত শক্ত নয়।

0 Shares