চরিত্রহীন

সরোজিনীর জননী জগৎতারিণীর আগ্রহটাই যে এ-বিষয়ে সবচেয়ে বেশী, তাহা বছর খানেক পূর্বে কলিকাতাতেই জানা গিয়াছিল। কিন্তু আগ্রহ এবং ব্যাকুলতা সর্বাপেক্ষা অধিক বলিয়াই বোধ করি সমস্ত লোকের মধ্যে শুদ্ধ মাত্র তাঁরই মনের মধ্যে একটা সংশয়ের ছায়া ছিল, কি জানি তাঁর শিক্ষিতাভিমানিনী কন্যা চিরদিনের সমাজ ও সংস্কার কাটাইয়া সতীশকে গ্রহণ করিতে রাজী হইবে কি না! সম্প্রতি তিনি বাপের বাড়ি শান্তিপুরে গিয়াছিলেন, ফিরিয়া আসিয়াই কথাটা তিনিই পাকা করিয়া লইবেন এমনই একটা ইঙ্গিত যাইবার সময় জগৎতারিণী প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।

সকালে সতীশ বেহালায় নূতন তার চড়াইতেছিল, বেহারীর সঙ্গে একজন ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি জ্যোতিষবাবুর বাড়ির সরকার। জগৎতারিণীর সঙ্গে শান্তিপুরে গিয়াছিলেন, আবার তাঁর সঙ্গেই ফিরিয়া আসিয়াছেন।

সরকার নমস্কার করিয়া জানাইল, মা আপনাকে আজ আহারের নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছেন।

খবর শুনিয়া সতীশের বুকের রক্ত চমক খাইয়া গেল, কহিল, তিনি কবে ফিরে এলেন?

সরকার কহিল, আজ তিনদিন হলো।

প্রায় ছয়-সাতদিন হইল সতীশ ওদিকে যায় নাই। তাহাদের সম্বন্ধটা অত্যন্ত স্পষ্ট হইবার পর হইতে জ্যোতিষবাবুর বাড়িতে যখন-তখন বেড়াইতে যাইতে তাহার লজ্জা করিত। কহিল, আচ্ছা, মাকে জানাবেন আমি দশটা-এগারটার মধ্যেই গিয়ে হাজির হব।

যে আজ্ঞা, বলিয়া লোকটা নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল।

সতীশকে নিমন্ত্রণ করিতে পাঠাইয়া দিয়াও জগৎতারিণী আহারের কোনরূপ উদ্যোগ না করিয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন, কারণ তাঁহার ধারণা ছিল, সতীশ সন্ধ্যার পূর্বে আসিবে না। এখন সরকারের মুখে খবর শুনিয়া তিনি ব্যস্ত এবং ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন।

আজ ছিল একাদশী। তাঁহার নিজের জন্য কোনরূপ আয়োজনের আবশ্যক ছিল না, এবং যে বিধবা ব্রাহ্মণকন্যার দ্বারা তাঁহার রাঁধাবাড়ার কাজ চলিত, তিনিও দিন-দুই হইতেই শান্তিপুরের কল্যাণে ম্যালেরিয়া জ্বরে শয্যাগত ছিলেন।

অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া সরকারকে কহিলেন, তুমি এবেলা খাবার কথা বলে আসতে গেলে কেন? তোমার কি কোন বুদ্ধিই নেই?

সরকার ভয়ে ভয়ে কহিল, আমি বলিনি, তিনি নিজেই এবেলার কথা বলেছিলেন।

জগৎতারিণী তখন রাগ করিয়া হুকুম করিলেন, তবে তুমিই যাও বাপু, ভাল মাছ-টাছ কোথায় পাওয়া যায়, শিগগির নিয়ে এসো।

আজ সকাল হইতেই যেজন্য তাঁহার মন বিগড়াইয়া গিয়াছিল, তাহার হেতু ছিল। সতীশকে নিমন্ত্রণ করিতে পাঠাইবার পরে তিনি খবর পাইয়াছেন কাল রাত্রে সহসা শশাঙ্কমোহন পুনরায় আসিয়া হাজির হইয়াছেন। এই লোকটাকে উৎকট সাহেবীয়ানার জন্য তিনি কোনদিন দেখিতে পারিতেন না, এবং বিশেষ করিয়া যখন হইতে শুনিয়াছিলেন সে সরোজিনীর পাণিপ্রার্থী তখন হইতে লোকটি তাঁহার দু’চক্ষের বিষ হইয়া গিয়াছিল। দিন-কুড়ি পূর্বে যখন সে কি উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া কলিকাতা হইতে এখানে আসিয়াছিল তখন জগৎতারিণী তাহাকে একপ্রকার স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিলেন যে তাঁহার কন্যার সহিত বিবাহ অসম্ভব। তবুও বেহায়া লোকটা বলা

নাই, কহা নাই, আবার আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে শুনিয়াই তাঁহার চিত্ত সংশয়ে কণ্টকিত হইয়া উঠিয়াছিল। তা ছাড়া, এ সংবাদ একটুখানি পূর্বাহ্ণে জানিতে পারিলে আজ সতীশকে হয়ত তিনি নিমন্ত্রণ করিতেই পাঠাইতেন না। কেন এ খবর যথাসময়ে তাঁহাকে জানান হয় নাই বলিয়া তিনি জ্যোতিষ হইতে বাড়ির বেহারাটা পর্যন্ত সকলের উপরেই চটিয়া গিয়াছিলেন। সরোজিনী বাহিরে বসিবার ঘর হইতে বাহির হইয়া কোনমতে মায়ের চোখ এড়াইয়া উপরে যাইতেছিল—শশাঙ্কমোহনের আগমন সেও জানিত না। কিন্তু জগৎতারিণী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহার আপাদমস্তক ক্ষণকাল নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিয়া গূঢ় ক্রোধের স্বরে বলিলেন, বেড়ানো হলো ত? এখন জুতা-মোজাটা একদণ্ড ছাড় বাছা! সতীশ আজ এখানে খাবে, আমি নিজে না রাঁধলে ত তোমাদের এই খ্রিষ্টানের বাড়িতে সে জলস্পর্শ করবে না। যাও, ঘাগ্‌রা-টাগ্‌রা ছেড়ে আমার রান্নাঘরে এসো গে। বুড়ো মায়ের একটুখানি সাহায্য করলে তোমাদের যীশুখৃষ্ট রাগ করবেন না বাছা, যাও।

মা রাগিলে যে কিরূপ অগ্নিমূর্তি হইতেন এবং সত্য-মিথ্যা নির্বিচারে লঙ্ঘন করিয়া যা মুখে আসে বলিতেন, তাহা কাহারও অবিদিত ছিল না। সরোজিনী কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, আমি এখুনি আসচি মা।

কিন্তু মায়ের রাগ তাহাতে কিছুমাত্র শান্ত হইল না; বলিলেন, এসেই বা আমার কি মাথা কিনবে মা? সতের-আঠার বছরের মেয়ে হলে, আজও এক মুঠা চাল সিদ্ধ করতে শিখলে না। আমরাও গরীবের ঘরের মেয়ে ছিলুম না মা, কিন্তু ও-বয়সে সংসার চালিয়ে এসেচি। বামুনমেয়ে আজ যদি চলে যায়, আমাকে তা হলে খাবার অভাবে শুকিয়ে মরতে হবে। যে ঘর-সংসারে ধর্ম-কর্ম নেই, সে ঘরে ছেলেমেয়ে পেটে ধরাই বৃথা! এই কঠোর মন্তব্য অত্যন্ত কঠিন করিয়া ব্যক্ত করিয়া জগৎতারিণী মুখ হাঁড়িপানা করিয়া নিজেই রান্নাঘরে গিয়া প্রবেশ করিলেন। কিন্তু কেন যে তাঁহার নিজের ছেলে-মেয়ে এবং নিজের সংসারের আচার-ব্যবহারের উপর এই মর্মান্তিক আক্রোশ, তাহা তাঁহার পূর্ব-ইতিহাস হইতে অনেকটা বুঝা যাইবে।

0 Shares