চরিত্রহীন

সন্ধ্যার পূর্বেই দ্বিতলের ঘরটিতে সমবেত হইয়া দুই-এক পাত্র সেবন করার পরে সতীশের সেই নির্জীব ভাবটা কাটিয়া গিয়াছিল। কিন্তু, তবুও অন্তরে পীড়ার গ্লানি তাহাকে ভিতরে ভিতরে পীড়াই দিতেছিল। ঠিক এমনিই সময়ে পাশের ঘরে অকস্মাৎ বেহারীর গলা শুনিতে পাইয়া সতীশ পুলকিত-বিস্ময়ে চঞ্চল হইয়া উঠিল।

হাঁক দিয়া ডাকিল, বেহারী নাকি রে?

বেহারী দ্বারের কাছে আসিয়া সসম্ভ্রমে সাড়া দিল, আজ্ঞে!

‘গুরুবাবা’র মুখ কালি হইয়া গেল। কহিলেন, এ ব্যাটা আবার ফিরে এলো নাকি বাবা? শালা ও-ঘরে ঢুকেছে কেন!

এই ঘরেই তাঁদের নিশীথ-চক্রের আয়োজন চলিতেছিল।

সতীশ এ-সকল প্রশ্নের উত্তর না দিয়া বেহারীকে জিজ্ঞাসা করিল, তুই বাড়ি গিয়েছিলি নাকি রে?

বেহারী কহিল, আজ্ঞে না, আমি কাশী গিয়েছিলুম।

কাশী? কাশীতে কেন?

মাকে আনতে।

সতীশ চমকিয়া উঠিল। বেহারী কাহাকে যে ‘মা’ বলে সতীশ তাহা জানিত। কহিল, সে কাশীতে থাকে নাকি?

আজ্ঞে হাঁ।

তুই তার ঠিকানা জানতিস?

বেহারী কহিল, না। কিন্তু, আমি জানতুম, মা যেখানেই থাকুন, বাবার মন্দিরে একদিন দেখা হবেই।

দেখা হয়েছিল?

আজ্ঞে হাঁ।

সতীশের বুকের ভিতরটায় তোলপাড় করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ স্থিরভাবে আপনাকে সামলাইয়া লইয়া শুষ্ককণ্ঠে কহিল, কিন্তু আমাকে না জানিয়ে সেখানে যাওয়া তোর ভাল কাজ হয়নি। তাদের মান-সম্ভ্রম লজ্জা-শরমের জ্ঞান নেই,—তোকে আহাম্মক পেয়ে তোর সঙ্গে যদি চলেই আসত, আজ তা হলে তুই কি বিপদেই পড়তিস বল্‌ ত?

বেহারী নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।

সতীশ তখন নিজেই আবার কহিতে লাগিল, বাড়ি ঢুকতে ত দিতাম না,—ফটকের বাইরে থেকেই দরোয়ান দিয়ে দূর করে দিতাম। তাকে নিয়ে এই রাত্রে তুই কি মুশকিলে পড়ে যেতিস ভেবে দেখ্‌ দেখি? সাধে কি আর লোকে তোদের ভেমো-গয়লা বলে রে! আচ্ছা, যা, খাওয়া-দাওয়া কর গে যা। কালীচরণ, বেশ একটু বড় করে একপাত্র দাও ত ভাই।

হুকুমমাত্র কালীচরণ একপাত্র ‘কারণ’ মূল সাধকের হাতে তুলিয়া দিল।

বেহারী মৃদুকণ্ঠে কহিল, বাবু, মা একবার আপনাকে ডাকচেন!

সতীশ পাত্র মুখে তুলিতে যাইতেছিল, চমকিয়া কহিল, কে ডাকচেন বললি?

বেহারী বলিল, মা।

সতীশ হতবুদ্ধির মত হাতের পাত্রটা পিকদানিতে উপুড় করিয়া দিয়া কহিল, তোর সঙ্গে এসেচে? তা আগে বললি নে কেন?

বেহারী তাহার জবাব না দিয়া পুনরায় কহিল, তিনি এখুনি একবার ডাকচেন।

সতীশ গলা একটু খাটো করিয়া বলিল, তুই বল্‌ গে বেহারী, যে, বাবুর জ্বর হয়েচে, তাই বাইরে জন-কয়েক বন্ধু তাঁকে দেখতে এসেছেন। আধ-ঘণ্টা পরে যাচ্চি, বল্‌ গে যা।

বেহারী তাহার হাতের পাশের দরজাটা চোখের ইঙ্গিতে নির্দেশ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, মা এই যে দাঁড়িয়ে রয়েচেন, একবার বেরিয়ে আসুন।

সতীশ চকিত হইয়া নিঃশব্দে অঙ্গুলি-সংকেতে প্রশ্ন করিল, এই ঘরে?

বেহারী ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল, হাঁ, এই যে।

সতীশ চট করিয়া গোটা-দুই লবঙ্গ এলাচ মুখে ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া দেখিল তাহার পাশের দরজার অন্তরালেই সাবিত্রীর অঞ্চল-প্রান্ত দেখা যাইতেছে! সে যে স্বকর্ণে সমস্ত শুনিয়াছে, তাহাতে কোন সংশয় নাই। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল বোকা বেহারীকে বেশ করিয়া দুই গালে চড়াইয়া দেয়।

সাবিত্রী উঁকি মারিয়া দেখিয়া চুপি চুপি কহিল, ঘরের ভিতরে এসো।

এই কণ্ঠস্বরের সুরে তাহার বুকের সমস্ত তারগুলা যেন বাঁধা ছিল,—সমস্ত এক সঙ্গে ঝমঝম করিয়া ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিল। সে ঘরে ঢুকিতেই সাবিত্রী কহিল, জ্বর হয়েচে বলছিলে যে?

সতীশ মাথা নাড়িয়া বলিল, জ্বর হয়েচে ত।

কৈ দেখি? বলিয়া সতীশের কাছে আসিয়া হাত বাড়াইয়া সতীশের কপালের উত্তাপ অনুভব করিয়া চমকিয়া বলিল, হাঁ—সত্যিই জ্বর যে! গা যেন পুড়ে যাচ্চে,—এসো, আমি বিছানা করে দিচ্চি, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে চল। বেহারী, বাবুর ঘরে একটা আলো জ্বেলে দেবে এসো, বলিয়া সাবিত্রী তেতালার সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হইয়া গেল। সে বাড়ি ঢুকিয়াই বাবুর শোবার ঘরটা বেহারীকে জিজ্ঞাসা করিয়া লইয়াছিল।

পালঙ্কের উপর শয্যা প্রস্তুত করাই ছিল, শুধু আঁচল দিয়া একবার ঝাড়িয়া দিতেই সতীশ শান্ত বালকের মত চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল। শিয়রে এবং পায়ের দিকের জানালা দুটা বন্ধ করিয়া দিয়া বেহারীকে জিজ্ঞাসা করিল, সাধুটি থাকেন কোন্ ঘরে?

বেহারী পাশের ঘরটা দেখাইয়া দিলে সাবিত্রী কহিল, তাঁর কি কি আছে ওখানে নীচে দিয়ে এসো বেহারী। বাইরের এক সার ঘর ত অমনি পড়ে আছে—তার কোন একটাতে বেশ থাকতে পারবেন তিনি। বেহারী চলিয়া যাইতেছিল, সাবিত্রী ডাকিয়া বলিয়া দিল, অমনি যাঁরা বাবুকে দেখতে এসেছিলেন, তাঁদেরও বাড়ি যেতে বলে দিয়ো। বলো, বাবুর জ্বর বেশী হয়েচে, আর নামতে পারবেন না।

সতীশ একটা কথাতেও কথা যোগ করিল না, মুখ বুজিয়া পড়িয়া রহিল।

বেহারী বীর-দর্পভরে আদেশ প্রতিপালন করিতে প্রস্থান করিতে সাবিত্রী বলিল, আর উঠো না যেন। আমি খাবার ব্যবস্থাটা ঠিক করে দিয়ে আসি। বলিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া নিঃশব্দ-পদসঞ্চারে চলিয়া গেল।

0 Shares