চরিত্রহীন

বেহারী কহিল, কতদিন বলবার জন্যে আমার যেন বুক ফেটে যেত বাবু, কিন্তু কিছুতেই মুখ ফুটোতে পারতুম না।

কেন শুনি?

আমার সাবিত্রী-মায়ের মাথার দিব্যি দিয়ে নিষেধ ছিল বাবু।

সতীশ আবার একটুখানি মৌন থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, সে যেন হলো বেহারী, কিন্তু সেদিন রাত্রে সাবিত্রী নিজের মুখেই ত বলে গিয়েছিল সে বিপিন ছাড়া কাউকে চায় না,—তার সঙ্গেই সে চলে যাচ্চে। তার কি বল দেখি?

বেহারী বলিল, এই কথাটা আমি নিজেও বুঝতে পারিনে বাবু। তবু আমি নিশ্চয় জানি, এ মিথ্যে! মিথ্যে! একেবারে ঘোর মিথ্যে! এ যদি মিথ্যে না হয় ত আমার একটা ছেলেও যেন বাঁচে না বাবু। মায়ের যাবার সময় কেঁদে বললুম, কেন এ মিথ্যে কলঙ্কের ডালি নিজের মাথায় তুলে নিলে মা? তবু, মা আমাকে প্রকাশ করবার হুকুম দিলে না। আমায় নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বেহারী, আমার মাথার দিব্যি রইল বাবা, বাবুকে এ-সব কথা তুমি বলো না। তিনি আমাকে ঘেন্না করুন, আর কখনো মুখ না দেখুন, সেও আমার ঢের ভাল, তবু তাঁকে বলো না যে, আমি নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে চলে গেলুম। বলিয়া বেহারী সে-রাত্রের স্মৃতির বেদনায় ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

কিন্তু, প্রভুর চোখ দিয়াও যে হুহু করিয়া জল পড়িতেছিল, বৃদ্ধ ভৃত্য তাহা দেখিতেও পাইল না।

অনেকক্ষণ পরে সতীশ অলক্ষ্যে অশ্রু মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, তুই বুঝতে পারিস নি বেহারী, কিন্তু আমি বুঝেছি, কেন সে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেছিল। কিন্তু মিথ্যের ত জয় হয় না বেহারী—

বাহির হইতে দ্বারে করাঘাত পড়িল—ও কি দোর বন্ধ করে ঘুমোলে নাকি গো? খিল খুলে দাও।

বেহারী প্রভুর মুখের পানে চাহিল, কিন্তু প্রভু নিরুত্তরে চোখ বুজিয়া চুপ করিয়া শুইয়া পড়িলেন।

বাহির হইতে পুনরায় শব্দ আসিল—দোর খুলে দাও না, হাত পুড়ে গেল যে!

বেহারী উঠিয়া কবাট খুলিয়া নীরবে পাশ কাটাইয়া সরিয়া পড়িল।

পরিচ্ছেদ – চল্লিশ

এক বাটি গরম দুধ হাতে সাবিত্রী ঘরে ঢুকিয়া তাড়াতাড়ি সেটা পাশের টিপয়ের উপর নামাইয়া রাখিল। তাহার পরনে ধপধপে গরদের শাড়ি, সদ্যস্নাত সুদীর্ঘ সিক্ত কেশভার পিঠ ছাড়াইয়া নীচে ঝুলিয়া পড়িয়াছে, কয়েকটা চূর্ণকুন্তল মুখের উপর কপালের উপর আসিয়া পড়িয়াছে, সতীশ আড়চোখে চাহিয়া দেখিল। তাহার হঠাৎ মনে হইল, সাবিত্রীকে আজ যেন সে এই প্রথম দেখিল।

কিন্তু সে সতীশের আর্দ্র চক্ষু-পল্লব এই ক্ষীণ দীপালোকে দেখিতে পাইল না। একটুখানি সরিয়া কাছে আসিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, দোর দিয়ে বসে প্রভু-ভৃত্যে কি পরামর্শ হচ্ছিল শুনি? বেহায়া আপদটাকে কি করে ফটকের বাইরে দূর করে দেওয়া যায়, এই না?

সতীশ সাড়া দিল না। পাছে কথা কহিলে কণ্ঠস্বরে ভিতরের দুর্বলতা ধরা পড়ে, এই ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।

সাবিত্রী বলিল, ছেলেবেলায় সেই বেড়ালের গলায় ঘণ্টা-বাঁধার গল্প পড়েচ ত? আমিও দেখতে চাই এ-ক্ষেত্রে ঘণ্টা বাঁধতে কে এগিয়ে আসে। তুমি নিজে, না তোমার ও সাধুজীটি!

তবুও সতীশ কথা বলিল না, যেমন চুপ করিয়া ছিল তেমনি রহিল।

একটা চৌকি টানিয়া লইয়া সাবিত্রী কাছে বসিল। কিন্তু এবার তাহার পরিহাস-তরল কণ্ঠস্বর গম্ভীর হইল। কহিল, তামাশা যাক, কাণ্ডটা কি আমাকে বুঝিয়ে দিতে পার? উপীনদার সঙ্গে ঝগড়া করলে, শেষে কিনা সরোজিনীর সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়া করে চলে এলে। তা না হয় একদিন মিটে যাবে জানি, কিন্তু একি হচ্ছে? আমার গা-ছুঁয়ে দিব্যি করেছিলে মদ ছোঁবে না, তা মদ চুলোয় যাক, গাঁজা খেতে ধরেচ! তাও আবার সোজা করে নয়,—যত সমস্ত অভাগার দল জুটিয়ে, গেরুয়া কাপড় পরে যন্ত্র-মন্ত্রের ঢাক পিটে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে খাওয়া চলেচে!

সাবিত্রীর মুখে সরোজিনীর উল্লেখে সতীশের গা জ্বলিয়া গেল। বেহারী যে কিছুই বলিতে বাকী রাখে নাই, তাহা সে বুঝিল। একবার তাহার ঠোঁটে আসিয়া পড়িল তোমার জন্যেই আমার সর্বনাশ—তুমিই আমার শনি! কিন্তু সে কথা চাপিয়া গিয়া শুধু ধীর-গম্ভীর গলায় সংক্ষেপে বলিল, বুক ফুলিয়ে মদ-গাঁজা খাওয়ার দোষ কি?

দোষ কি সে তুমি জানো না?

না

আচ্ছা, তাও যদি না জানো, এটা ত জানো যে, আমার গা-ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলে খাবে না?

তুমি আমার কে যে, কবে জোর করে দিব্যি করিয়ে নিয়েচ বলে সে একটা মস্ত বাধা!

সাবিত্রী কোনমতে হাসি চাপিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, কেউ নয় আমি? একেবারেই কেউ নয়?

সতীশও ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

তবে মদের গেলাস পিকদানিতে ঢেলে ফেলে এলাচ চিবোতে চিবোতে এসেছিলে কেন?

সে শুধু তুমি বকাবকি করবে এই ভয়ে।

সাবিত্রী হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, তবু সাবিত্রী কেউ নয়। আচ্ছা, এখন একটু দুধ খেয়ে ঘুমোও। বলিয় উঠিয়া গিয়া দুধের বাটিটা হাতে লইয়া সতীশের সুমুখে দাঁড়াইল। সতীশ আপত্তি করিল না, উঠিয়া বসিয়া সমস্ত দুধটুকু পান করিয়া শুইয়া পড়িল।

সাবিত্রী বাটিটা হাতে করিয়া চলিয়া যাইতেছিল, সতীশ ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার আহ্নিক সারা হয়েছে?

সাবিত্রী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, হাঁ।

কি খেলে?

0 Shares