চরিত্রহীন

ডিস্পেন্‌‌সারির ডাক্তারবাবু আসিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সতীশকে পরীক্ষা করিয়া মুখ বিকৃত করিয়া কহিলেন, তাই ত! এ যে নিমোনিয়ার লক্ষণ দেখি। ভয় নেই, রোগ এখনও বাড়তে পারেনি।

ভরসা দিয়া, সান্ত্বনা দিয়া, ডাক্তারবাবু স্বহস্তে ঔষধ প্রস্তুত করিবার জন্য নীচে চলিয়া গেলেন, সতীশ কষ্টে একটুখানি হাসিয়া সাবিত্রীর মুখের পানে চাহিয়া কহিল, ভয় আমি একতিল করিনে। বলিয়া বালিশের তলায় হাত দিয়া একটা চাবির গোছা বাহির করিয়া দেখাইয়া কহিল, এটা চিনতে পার সাবিত্রী? নিজে ইচ্ছে করে একদিন যাকে আঁচলে বেঁধেছিলে, আজ আমিই তাকে তোমার আঁচলে বেঁধে দিই, বলিয়া সাবিত্রীর অশ্রুসিক্ত আঁচলখানি টানিয়া লইয়া ধীরে ধীরে তাহার চাবির রিংটা বাঁধিয়া দিয়া, একটা শান্তির নিশ্বাস ফেলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল।

সাবিত্রীর প্রতি বেহারীর নির্ভরতার অন্ত ছিল না; তাহার কাছে সাহস পাইয়া সে প্রথমটা প্রফুল্ল হইল বটে, কিন্তু সে ত ছেলেমানুষ নহে, দিন-কয়েক পরে সে-ই সাবিত্রীর মুখের চেহারা দেখিয়া মনে মনে ভীত হইয়া উঠিল। সে লক্ষ্য করিয়া স্পষ্ট দেখিতেছিল, এই অসীম কর্মপটু সহিষ্ণু রমণীর শান্ত মুখের উপর একটা পাণ্ডুর ছায়া ক্রমশঃ ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছে।

আট-দশদিন পরে একদিন সন্ধ্যায় সে সাবিত্রীকে নিভৃতে পাইয়া সহজ-কণ্ঠে কহিল, মা, এই বুড়োকে ভুলিয়ে কি হবে? তোমার ওই কচি বুকে যা সহ্য হবে, তাই এই বুড়ো হাড়ে কি সইবে না মা? তার চেয়ে আমাকে সব কথা খুলে বল, আমি দেখি যদি কিছু উপায় করতে পারি।

সাবিত্রী একটুখানি স্থির থাকিয়া বলিল, তোমাকে এখনো বলিনি বেহারী, কিন্তু তোমার নাম করে উপীনবাবুকে আজ সকালে আমি চিঠি লিখে দিয়েচি। দু’দিন অপেক্ষা করে দেখি, যদি তিনি না আসেন, তোমাকে নিজে একবার তাঁর কাছে যেতে হবে বেহারী।

বেহারী উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল, আমাকে না বলে এ কাজ কেন করলে মা!

কেন বেহারী, তিনি কি আসবেন না?

বেহারী মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, তিনি আসতেও পারেন, কিন্তু আমাকে কেন একবার জানালে না মা?

কেন বেহারী?

বেহারী সঙ্কোচে চুপ করিয়া রহিল। কথাটা বলা দরকার। কিন্তু এই অত্যন্ত অপমানকর বাক্যটা তাহার মুখ দিয়া সহসা বাহির হইতে চাহিল না।

সাবিত্রী কহিল, এ-সময়ে তাঁর আসা যে নিতান্ত দরকার বেহারী?

বেহারী বহু কষ্টে সঙ্কোচ কাটাইয়া বলিয়া উঠিল, সে ত জানি মা, কিন্তু তুমি কাছে না থাকলে পৃথিবীর সমস্ত লোক বাবুর বিছানা ঘিরে থাকলেও ত তাঁকে বাঁচাতে পারা যাবে না, সে-কথা কেন ভেবে দেখনি মা!

সাবিত্রী কহিল, ভেবেচি বেহারী। আমি বাড়ির যেখানে হোক নুকিয়ে থেকে আমার কাজ করতে পারব, কিন্তু উপীনবাবুর যে না এলেই নয়! তা ছাড়া আমি মেয়েমানুষ, এ বিপদের কতটুকু ভাল-মন্দই বা বুঝি! না বেহারী, তিনি আসুন।

বেহারী ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে কহিল, উপীনবাবুর কথা জানিনে মা, কিন্তু বাবুর কথা জানি। নির্বোধ বটে, কিন্তু এই ষাট বচ্ছর ধরে সংসারটা ত দেখচি? কটা পুরুষমানুষ তোমার চেয়ে ভাল-মন্দ বেশী বোঝে মা? তা সে যাই হোক, তুমি কাছ থেকে সরে গেলে এ-যাত্রা বাবুকে যে ফেরাতে পারব না, এ কথা আমি তোমার পা ছুঁয়ে পর্যন্ত দিব্যি করে বলতে পারি। এমন কাজ কোরো না মা, তুমি আমার বাবুকে ছেড়ে আর কোথাও পালিয়ে থেকো না।

এ কথা বেহারীর চেয়ে সাবিত্রী যে কম জানিত তাহা নহে, কিন্তু চুপ করিয়া রহিল। তাহাকে হাতের কাছে না পাইলে সতীশের ব্যাকুলতা যে কতখানি বাড়িবে, সে সতীশই জানে; কিন্তু এই নিদারুণ রোগশয্যায় সতীশকে চোখের আড়াল করিয়া সাবিত্রী আপনিই বা বাঁচিবে কি করিয়া? তাহাদের প্রতি উপেন্দ্রর ঘৃণা তাহার অবিদিত ছিল না। তিনি আসিলে তাহাকে আত্মগোপন করিতেই হইবে, তাহাতে লেশমাত্র সংশয় নাই—সমস্তই সে মনে মনে আলোচনা করিয়া দেখিয়াছিল, কিন্তু যাহার জন্য এতদিন এত দুঃখ সহিয়াছে, তাহার জন্য এ দুঃখও সহিবে; এই মনে করিয়াই সে উপেন্দ্রকে পীড়ার সমস্ত বিবরণ খুলিয়া লিখিয়া, আসিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিল।

সাবিত্রী দৃঢ়কণ্ঠে কহিল, না বেহারী, সে হতে দিতে পারব না। তিনি পরশুর মধ্যে না এসে পড়লে, তোমাকে নিজে গিয়ে তাঁকে আনতে হবে।

বেহারী ম্লানমুখেই কহিল, এ কথা কেন বলচ মা! আমি চাকর, আমাকে যা হুকুম করবে, তাই আমাকে করতে হবে। কিন্তু আমিও ত মানুষ? তোমার চোরের মত নুকিয়ে থাকা যদি কোনদিন সয়ে উঠতে না পারি মা, আমাকে গাল দিতে পারবে না, তা কিন্তু আগে থেকে বলে দিচ্চি, বলিয়া ক্ষুণ্ণচিত্তে চলিয়া গেল।

কিন্তু, সাবিত্রীর সে চিঠি উপেন্দ্রর হাতে পড়িল না। পিতা ও মহেশ্বরীর পুনঃ পুনঃ অনুরোধে সে মাস-খানেক পূর্বে নিজের সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধেও জলহাওয়া বদলাইতে পুরী যাইতে বাধ্য হইয়াছিল। এখানে কাহারো সহিত পরিচয় ছিল না বলিয়া প্রথম রাত্রে তাহাকে একখানা ছোট-রকম হোটেলে আশ্রয় লইতে হইয়াছিল। ইচ্ছা ছিল পরদিন সকালে একটা ভাল জায়গা অনুসন্ধান করিয়া লইবে। স্বত্বাধিকারী ভুবন মুখুয্যে মহাশয় কিন্তু খাতির-যত্নের অবধি রাখিলেন না—আলাদা ঘরে বিছানা করিয়া দিলেন, এমন কি, যতদিন খুশী এখানে থাকিলেও যত্নের ত্রুটি হইবে না ভরসা দিলেন।

0 Shares