চরিত্রহীন

জননীর আদেশে তাহাকে আদালত হইতে ফিরিয়া কাপড় ছাড়িয়া হাতমুখ ধুইয়া তবে জলযোগ করিতে হইত। মায়ের সহিত দেখা হইতেই কহিল, শশাঙ্ক এসেচেন, আজ খাবার বাইরে পাঠিয়ে দাও মা।

মা বলিলেন, আচ্ছা। বাইরে সরি আছে বুঝি?

জ্যোতিষ ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আছে। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আচ্ছা মা, এমন মানুষ কোথায় আছে জানো, যার শরীরে দোষ নেই, শুধুই গুণ?

প্রশ্নটাকে জগৎতারিণী প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করিলেন না, কহিলেন, কেন তোরা যখন-তখন আমাকে ও-কথা বলিস জ্যোতিষ? আমি ত অনেক বার বলেচি, আর আমার আপত্তি নেই। তোরা ভাল বুঝিস ওর হাতেই সরিকে দে না।

জ্যোতিষ কহিল, দোষ ছাড়া মানুষ নেই মা। কিন্তু আমি অনেকরকম করে ভেবে দেখেচি, সরোজিনী অসুখী হবে না। তা ছাড়া, ও বড় হয়েচে, ওর অমতেও কাজ করা যায় না। বলিয়াই দেখিতে পাইল, সরোজিনী আসিয়া ধীরে ধীরে দাদার পিঠ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল।

মা ভাঁড়ার ঘরের দরজার ভিতর হইতে কথা কহিতেছেন, সুতরাং তিনি কন্যার আগমন টের পাইলেন না। জ্যোতিষের কথার উত্তরে বিরক্তিপূর্ণ স্বরে বলিলেন, এ কথা ত আমি কোনদিন বলিনে জ্যোতিষ, ঐ ধাড়ি-মেয়ের বিয়ে তার অমতেই দেওয়া হোক। আমার যা সাধ ছিল, সে যখন তোরা দু’ ভাই-বোনে মিলে ঘুচিয়ে দিলি, তখনই কি মেয়ের মনের ভাব আমি বুঝিনি বাছা! আমি সব বুঝি, বুঝেই ত মুখ বুজে আছি। এখন আমাকে মিথ্যে খোঁটা দেওয়া জ্যোতিষ, বলিয়া তিনি জলখাবার সাজাইতে বসিলেন। সঙ্কোচে, লজ্জায় সরোজিনী মাটির সঙ্গে মিশিয়া গেল। মা কিন্তু তাহার কিছুই জানিলেন না। জ্যোতিষ জবাব দিবার পূর্বেই তিনি নিজের কথার অনুবৃত্তিস্বরূপে পুনরায় বলিতে লাগিলেন,—যাকে পেলে তোমার বোন খুশী হবেন, তাকেই দাও গে বাছা, আমার মত আর বার বার জানতে হবে না। আমার মত আছে, তোমাদের বলে দিলাম।

ভগিনীর নিরতিশয় সঙ্কোচে জ্যোতিষ নিজেও অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করিতেছিল, তবুও জোর করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, কিন্তু মতটা প্রসন্নমনে দেওয়া চাই মা!

জগৎতারিণী কহিলেন, প্রসন্নমনেই দিচ্চি বাছা, প্রসন্নমনেই দিচ্চি। আমাকে আর বিরক্ত করো না তোমরা।

জ্যোতিষ একটুখানি চুপ করিয়া ভাবিয়া দেখিল, ব্যাপারটা যদি এতটাই গড়াইল, তবে মায়ের বিরক্তি সত্ত্বেও আজই একটা মীমাংসা করিয়া লওয়া উচিত। কারণ; তাহাদের ক্লাবে, লাইব্রেরিতে এ কথাটা আজকাল প্রায়ই আলোচিত হইতেছে, অথচ, ঠিক কি হইবে তাহাও বুঝা যাইতেছে না। বাড়িতেও কথাটা প্রায়ই উঠে বটে, কিন্তু এমনি করিয়াই থামিয়া যায়—অগ্রসর হইতে পারে না। শশাঙ্ককেও এইরূপ অনিশ্চিতের মধ্যে দীর্ঘকাল ফেলিয়া রাখা যায় না। সুতরাং বর-কন্যার সুনিশ্চিত কামনার বিরুদ্ধে জননীর স্পষ্ট অনিচ্ছা জ্যোতিষ মাথায় পাতিয়া লইয়াই যা হোক একটা কিছু এখনি স্থির করিয়া ফেলিবার জন্য কহিল, তা হলে আমি মনে করচি মা, দু-চারজন বন্ধু-বান্ধবদের সামনে পরশু রবিবারেই কথাটা পাকা হয়ে যাক,—কি বল?

মা বলিলেন, ভালই ত।

সরোজিনী ধীরে ধীরে তাহার ঘরে চলিয়া গেল।

রবিবারের সকালে জ্যোতিষের বসিবার ঘরটা বন্ধু-বান্ধবে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছিল। নব-দম্পতির বিবাহ সম্বন্ধে পাকা কথা হইবার পরে এইখানেই মধ্যাহ্ন-ভোজেরও একটা আয়োজন করা হইয়াছিল। আজ শশাঙ্কর বেশভূষাতেই শুধু যে বিশেষ একটু পারিপাট্য লক্ষিত হইতেছিল তাহা নয়, তাহার মুখ-চোখেও আজ এমন একটু শ্রী ফুটিয়াছিল—যাহাতে তাহাকে সুন্দর দেখাইতেছিল। কয়েকটি মহিলাও উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু উপস্থিত ছিল না শুধু সরোজিনী। বেহারাকে দিয়া ডাকাইবার পরে জ্যোতিষ নিজে গিয়া তাহার ঘরের দ্বারে করাঘাত করিয়া সত্বর হইবার জন্য অনুরোধ করিয়া আসিয়াছিল। অন্য কোনদিন হইলে তাহার এই আচরণ অপরাধ বলিয়া গণ্য হইতে পারিত, কিন্তু আজ মার্জনা পাইবার অধিকার আছে বলিয়া সস্নেহ-কৌতুকে অতিথিরা জ্যোতিষকেই শুধু তাড়া দিয়াছিলেন মাত্র।

তার পরে অনেক ডাকাডাকিতে বেলা দশটার কাছাকাছি সরোজিনী যখন উপস্থিত হইল, তখন তাহার চেহারা দেখিয়া উপস্থিত সকলেই বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তাহার মুখ পাণ্ডুর, চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে, যেন সারারাত্রি সে এতটুকু ঘুমায় নাই। জ্যোতিষ নির্বাক হইয়া শুধু ভগিনীর মুখের প্রতি চাহিয়া বসিয়া রহিল,—আকৃতি দেখিয়া সে যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেল।

কিন্তু, ইহার অপেক্ষাও শতগুণ বড় বিস্ময় যে মুহূর্তকাল পরেই তাহার অদৃষ্টে ছিল তাহা সে জানিত না। সেই প্রচণ্ড বিস্ময় যেন উপেন্দ্রর অতীতের ছায়া লইয়া সম্মুখের পর্দা সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। জ্যোতিষ চমকাইয়া উঠিল, বলিল, এ কি, উপীন নাকি!

সরোজিনী কহিল, উপীনবাবু!

বস্তুতঃ, দিনের বেলা না হইলে তাহাকে বোধ হয় ইহারা চিনিতেই পারিত না। সহসা নিজের চক্ষুকেই যেন অবিশ্বাস হয়—যেন ভাবা যায় না মানুষের দেহ এমন করিয়া পরিবর্তিত হইতে পারে! উপেন্দ্র একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িয়া কহিল, শরীরটা তেমন ভাল নেই,—পুরী থেকে আসচি। আজ ব্যাপার কী?

0 Shares