চরিত্রহীন

সাবিত্রীর নামে সরোজিনীর লজ্জা, শরম, বেদনা সমস্ত ভুলিয়া মুখ তুলিয়া দাঁড়াইল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে তাহাকে উপেন্দ্রর কোনরূপ আত্মীয়া বলিয়াই মনে করিয়াছিল।

সাবিত্রী নিঃশব্দে আসিয়া উপেন্দ্রর পায়ের কাছে মেঝের উপর বসিল। উপেন্দ্র তাহার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেন, তুমি মনে করো না দিদি, তোমার কাছে মাপ চেয়ে তোমার আমি অমর্যাদা করব। কিন্তু সতীশ, তুই আমাকে মাপ কর। তোর যত অপমান, যত অনিষ্ট আমি করেচি, সমস্ত আজ ভুলে যা ভাই।

সতীশ কথা কহিবে কি, সে অবাক হইয়া শুধু নিষ্পলক-চক্ষে চাহিয়া রহিল।

উপেন্দ্র একটুখানি ম্লান হাসিয়া কহিলেন, আমি বুঝেচি, সতীশ, তোরা কি ভাবচিস। ভাবচিস যে, সেই উপীনদা ছেলেমানুষের মত এত বকে কেন! কিন্তু তোরা জানিস নে ভাই, কতকাল তোদের উপীনদার এই মুখখানা একেবারে মূক হয়ে ছিল। তাই, যত কথা জমা হয়েছিল, সব আজ মাতালের মত বেরিয়ে আসচে, কাকে আটকে রাখি বল ত!

উপেন্দ্রর কথার ভঙ্গীতে সতীশের বুকের ভিতরটায় কি এক রকমের অজানা ভয়ে তোলপাড় করিতে লাগিল, কি একটা কথা সে জানিতেও চাহিল, কিন্তু, না পড়িল তাহার প্রশ্নটা মনে, না তাহার মুখ দিয়া কথা ফুটিল। সে যেমন চাহিয়া ছিল তেমনি চাহিয়া রহিল।

পরক্ষণেই উপেন্দ্র সরোজিনীর মুখের প্রতি চাহিয়া সতীশকে বলিলেন, তুই ভাল হ’, আশীর্বাদ করি তোরা সুখী হ’—আমি আমার এ বোনটিকে নিয়ে চলে যাব। বলিয়া উপেন্দ্র আস্তে আস্তে সাবিত্রীর মাথার উপর আঙুলের ঘা মারিয়া কহিলেন, তুমি ছাড়া আমার ভার নেবার আর কেউ নেই দিদি। আর যে অসুখ, তাতে আর কাউকে কাছে ডাকতে সাহসও হয় না, হওয়া উচিতও নয়। শুধু তোমার মত যার পরের জন্যই কেবল বেঁচে থাকা, আমার সেই বোনটির ওপরেই নিজেকে সঁপে দিতে পারি। যাবে দিদি আমার সঙ্গে? সতীশকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে,—তা হলোই বা। এর চেয়ে কত বেশী দুঃখ-কষ্ট যে ভগবান মানুষকে সইতে দিয়ে মানুষ করে তোলেন ভাই!

সতীশের মনের মধ্যে এতক্ষণের সেই বিস্মৃত প্রশ্নটা যেন বিদ্যুতের রেখায় খেলিয়া গেল। সে সহসা বলিয়া উঠিল, উপীনদা, আমাদের পশু-বৌঠান কেমন আছেন? তাঁর যে অসুখ শুনে এসেছিলাম।

উপেন্দ্র একমুহূর্তের জন্য দাঁত দিয়া জোর করিয়া অধর চাপিয়া ধরিলেন, তার পরে অভ্যাসমত একবার উপরের দিকে চাহিয়া বলিলেন, পশু নেই—মারা গেছে।

সরোজিনী চেঁচাইয়া উঠিল, সুরবালা-বৌদি নেই?

উপেন্দ্র ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না।

সতীশ মোটা বালিশটায় হেলান দিয়া মূর্ছাহতের মত শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া রহিল।

সুরবালা নাই, সে মারা গেছে! এই বার্তা উপেন্দ্রর মুখ দিয়া অতি সহজেই বাহির হইয়া আসিল; কিন্তু এ ‘নাই’ যে কি না-থাকা, এ যাওয়া যে কি যাওয়া, সতীশের চেয়ে কে বেশী জানে! সরোজিনীর চেয়ে কে বেশী দেখিয়াছে! সাবিত্রীর চেয়ে কে বেশী শুনিয়াছে!

তথাপি সুরবালা নাই—সে মরিয়াছে। সতীশের মুখের প্রতি চাহিয়া উপেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, ভগবান নিলেন, তার আর নালিশ কি! কিন্তু এ সময়ে দিবা-ছোঁড়াটা যদি কাছে থাকত! মা-বাপ নেই, ছেলেবেলা থেকে মানুষ করে এত বড় করলাম, সেও কোথায় গেল! কি জানি মরবার আগে একবার তাকে দেখতে পাব কি না।

সতীশ তেমনি মূর্ছাহতের মত থাকিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, দিবার কি হলো উপীনদা?

উপেন্দ্র কহিলেন, কি জানি তার কি হলো! কলকাতায় হারানদার বাড়িতে থেকে পড়তে দিলাম—এ লজ্জার কথা কারুকে বলাও যায় না, বলতে ইচ্ছেও করে না—বাড়িতে আজও জানে, সে কলকাতায় পড়চে, সুরো তাকে ভারী ভালবাসতো, সে বেচারা মরবার আগে দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু এ সাধ তার পূর্ণ করতে পারলাম না। হারানবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যে চলে গেল তার উদ্দেশও নেই।

তিনজন শ্রোতাই একসঙ্গে অব্যক্ত-কণ্ঠে কি একটা চীৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু কোন কথাই স্পষ্ট হইল না।

তার পরে সমস্ত নীরব। সমস্ত ঘরটা যেন একটা শূন্য শ্মশানের মত থমথম করিতে লাগিল।

কেহই উপেন্দ্রর মুখের পানে চাহিতেও পারিল না, কিন্তু প্রত্যেকেরই মনে হইতে লাগিল, তাহাদের এতদিনের দুঃখ-কষ্ট-মান-অভিমানগুলা যেন এই অভ্রভেদী বেদনার কাছে একেবারে তুচ্ছ হইয়া গেছে।

সাবিত্রী সতীশের কাছে সকল কথাই শুনিয়াছিল। সকল কথাই জানিত। সে ভাবিতে লাগিল, এই বিপুল শূন্যতা এই লোকটা কি দিয়া ভরিয়াছে! এ ব্যথা, সে কেমন করিয়া তাহার দৈনন্দিন জীবন-যাত্রার মধ্যে এত সহজে বহিয়া বেড়াইতেছে! বুকের ভিতরে যাহার এতবড় হাহাকার, বাহিরে তাহার এতটুকু আক্ষেপ নাই কেন? এ কি পাইয়াছে? কে ইহার সুখ-দুঃখ এমন সহজ সুসহ করিয়া দিয়াছে!

সে পায়ের উপর আস্তে আস্তে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিল, দাদা, এ-সব ব্যারামে তোমার পক্ষে পাহাড়ের হাওয়া খুব ভাল, না?

উপেন্দ্র তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, হাঁ ভাই, তাই ত ডাক্তারেরা বলেন, কিন্তু ভগবান যাকে তলব করেন, তার কিছুই কাজে লাগে না।

সাবিত্রী বলিল, তা হোক দাদা, আমরা কিন্তু পাহাড়ে গিয়েই থাকব।

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা, তাই হবে।

0 Shares