চরিত্রহীন

দিবাকর প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, অন্য কারও কথায় আমার কাজ নেই, বৌদি, কিন্তু আমার আজকের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে কি করে? আমাকে বলে দাও,—আমি তাই প্রাণপণে করব।

কিরণময়ী কহিল অপরাধ আবার কি? শোননি, এতে মানুষে মানুষকে খুন করে ফেলে? তুমি ত শুধু ঠেলে দিয়েছ,—অপরাধ আমি করিনি? সব কি কেবল তোমারই দোষ? কিন্তু, যাক গে এ-সব। সমস্ত অভিযোগ-অনুযোগের আজ শেষ হয়ে গেছে—এতে তোমারও ভবিষ্যতে আর দরকার হবে না,আমারও না। এখন যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসে ভাত খেতে বসো। আমি যেন আর দাঁড়াতে পাচ্চিনে।

দিবাকর ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। কিরণময়ীর কণ্ঠস্বরে সে বুঝিয়াছিল, আর কথাবার্তা কহিতেও সে ইচ্ছুক নয়।

সমস্তদিন উপবাসের পর দিবাকর খাওয়া শেষ করিয়া বাহিরে আঁচাইতে গেল। তাহার মনের গ্লানিটাও কমিয়া আসিয়াছিল। আঁচাইয়া হৄষ্টচিত্তে ঘরে ঢুকিয়া একটু আশ্চর্য হইয়াই দেখিল কিরণময়ী তাহার বিছানাটা গুটাইয়া খাট হইতে নীচে নামাইয়া রাখিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, নামাচ্চ কেন?

কিরণময়ী অবিচলিত—স্বরে কহিল, আগে বললে হয়তো তোমার খাওয়া হতো না, তাই বলিনি। আজ থেকে আমাদের মধ্যে আর দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। রাত এখনো বেশী হয়নি, আজকের মত কালীবাড়িতে গিয়ে শোও গে, কাল সুবিধে মত একটা বাসা খুঁজে নিয়ো। আর যদি এ দেশে না থাকতে চাও, পরশু স্টিমার আছে, আমি টাকা দেব, দেশে ফিরে যেয়ো। মোট কথা, যা ইচ্ছে হয় করো, আমার সঙ্গে আর তোমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না।

দিবাকর হতজ্ঞানের মত কথাগুলা শুনিয়া যাইতেছিল। তাহার মনে হইতেছিল, কিরণময়ীর মমতা-লেশহীন এক-একটি শব্দ যেন কঠিন পাষাণখণ্ডের মত তাহাদের মাঝখানে চিরদিনের অভেদ্য প্রাচীর গাঁথিয়া তুলিতেছে।

তাহার কথা শেষ হইলে, সে স্বপ্নাবিষ্টের মত কহিল, আর তুমি?

কিরণময়ী কহিল, আমার কথা শুনে তোমার লাভ নেই, তবে এ দেশে যদি থাকো, কাল-পরশু শুনতেই পাবে।

দিবাকর কহিল, তা হলে বাড়িউলীর কথাই সত্যি—সেই খোট্টা মারোয়াড়ীটাই—

কিরণময়ী কঠিনস্বরে জবাব দিল, হতেও পারে। কিন্তু, আর যাই হোক, তোমার কাঁধে ভর দিয়ে অধঃপথে নেমেছিলুম বলেই যে তার শেষ ধাপটি পর্যন্ত তোমাকেই আশ্রয় করেই নামতে হবে, তার কোন মানে নেই। আমার শরীর ভাল নেই, এখুনি শুয়ে পড়ব—আর তুমি অনর্থক দেরী করো না, যাও! কাল সকালে তোমার জিনিসপত্র তোমাকে পাঠিয়ে দেব।

দিবাকর কহিল, এত তাড়া! আজ রাত্রের মতও আমাকে তুমি থাকতে দেবে না?

কিরণময়ী কহিল, না।

দিবাকর ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিল, তা হলে আমার শুধু সর্বনাশ করবার জন্যই বিপদে টেনে এনেছিলে? কোনদিন ভালও বাসনি?

কিরণময়ী কহিল, না; কিন্তু তোমার নয়, আর একজনের সর্বনাশ করচি ভেবেই তোমার ক্ষতি করেচি। আর আমার? যাক আমার কথা। সমস্তই আগাগোড়া ভুল হয়ে গেছে। আর, এই ভুলের জন্যেই আজ তোমার পায়ে ধরে মাপ চাচ্চি ঠাকুরপো।

এই নির্বিকার পাষাণ-প্রতিমার মুখের প্রতি চাহিয়া দিবাকর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আমার সর্বনাশের ধারণা নেই তোমার, তাই তুমি এত সহজে মাপ চাইতে পারলে। কিন্তু, এই সর্বনাশের চেয়েও আজ আমার ভালবাসা অনেক বড়, তাই এখনো বেঁচে আছি, নইলে বুক ফেটে মরে যেতুম। কিন্তু একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বলো। যার কাছে তুমি যাবে, তাকেও ত ভালবাস না, হয়ত চেনোও না, তবু আমাকে ছেড়ে সেখানে যেতে চাও কেন? আমি ত কোনদিন তোমার কোন অনিষ্ট করিনি! কিন্তু সত্যিই কি যাবে?

কিরণময়ী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, সত্যিই যাব। তার পরে বহুক্ষণ পর্যন্ত মাটির দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, না, আজ আর কিছুই গোপন করব না। আমি ভগবান মানিনে, আত্মা মানিনে, জন্মান্তর মানিনে, স্বর্গ নরক ও-সব কিছুই মানিনে—ও সমস্তই আমার কাছে ভুয়ো, একেবারে মিথ্যে। মানি শুধু ইহকাল, আর এই দেহটাকে। জীবনে কেবল একটা লোকের কাছে একদিন হার মেনেছিলুম—সে সুরবালা। কিন্তু সে কথা থাক। সত্যি বলচি ঠাকুরপো, আমি মানি শুধু ইহকাল, আর এই সুন্দর দেহটাকে। কিন্তু আমার এমনি পোড়াকপাল যে, এই দিয়ে অনঙ্গের মত পতঙ্গটাকেও একদিন মজাতে চেয়েছিলুম।—বলিয়া ক্ষুদ্র একটি নিশ্বাস ফেলিয়া কিরণময়ী স্তব্ধ হইয়া রহিল।

মিনিট-দুই স্থির থাকিয়া সে সহসা যেন জাগিয়া উঠিয়া কহিল, তার পরে একদিন—যেদিন সত্যি সত্যিই ভালবাসলুম ঠাকুরপো, সেদিনই টের পেলুম, কেন আমার সমস্ত দেহটা এতদিন এমন করে এর জন্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করেছিল!

দিবাকর ব্যগ্র হইয়া কহিল, কাকে ভালবাসলে বৌদি?

কিরণময়ী একটু হাসিয়া, যেন নিজের মনেই বলিতে লাগিল, ভেবেছিলুম, আমার এ ভালবাসার তুলনা বুঝি তোমাদের স্বর্গেও নেই। কিন্তু সে গর্ব টিকল না। সেদিন মহাভারতের গল্প নিয়ে সেই যে মেয়েটার কাছে হেরে এসেছিলুম, আবার তার কাছেই হার মানতে হলে—ভালবাসার দ্বন্দ্বেও মাথা হেঁট করে ফিরে এলুম। মোহের ঘোর কেটে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তাকে রূপ দিয়ে ভোলাতে পারি এ সাধ্য আমার নেই।

0 Shares