চরিত্রহীন

দিবাকরের একবার মনে হইল তাহার নিবিড় অন্ধকার বুঝি স্বচ্ছ হইয়া আসিতেছে।

কিরণময়ী কহিতে লাগিল, সেই মেয়েটার কাছে একটা জিনিস শেখবার বড় লোভ হয়েছিল—সে আমার আপন স্বামীকে ভালবাসা—হয়ত শিখতেও পারতুম, কিন্তু, এমনি পোড়া অদৃষ্ট, সে পথও দু’দিনে বন্ধ হয়ে গেল। ভাল কথা, কি জিজ্ঞাসা করছিলে ঠাকুরপো, তোমাকে ভালবাসিনি কেন? কে বললে বাসিনি? বেসেছিলুম বৈ কি! কিন্তু বয়সে আমি বড়, তাই যেদিন তোমার উপীনদা আমার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়ে যান, সেই দিন থেকে তোমাকে ছোটভাইটির মত ভালবেসেছিলুম। তাই ত এই ছটা মাস নিজের ছলনায় আমি ক্ষত-বিক্ষত। তোমার চোখের ক্ষুধায়, তোমার মুখের প্রেম-নিবেদনে আমার সমস্ত দেহ ঘৃণায় লজ্জায় কেমন করে শিউরে ওঠে, তা কি একটা দিনও বুঝতে পারনি ঠাকুরপো? যাও, এবার তুমি সরে যাও। আমার পাপ-পুণ্য স্বর্গ-নরক না থাক, কিন্তু এই দেহটার ওপর তোমার লুব্ধদৃষ্টি আর আমি সইতে পারিনে। বলিয়া সে বিছানাটা তুলিয়া আনিয়া দিবাকরের সুমুখে ফেলিয়া দিয়া বলিল, আর তোমাকে আমার বিশ্বাস হয় না। আমার আরও একটি ছোটভাই আজও বেঁচে আছে। সেই সতীশের মুখ চেয়েও আমার চিরদিন তোমার কাছ থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। তুমি যাও—

দিবাকর আর দ্বিরুক্তি না করিয়া বিছানাটা তুলিয়া লইয়া বাহিরের অন্ধকারে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

পরিচ্ছেদ – তেতাল্লিশ

সকাল বেলা কিরণময়ী শ্রান্ত অবসন্ন দেহে কাজ করিতেছিল, কামিনী বাড়িউলী আসিয়া দোরগোড়ায় দাঁড়াইয়া একগাল হাসিয়া কহিল, গেছে ছোঁড়া? বালাই গেছে। কাল আমারে যেন মারমুখী! আরে, তোর কর্ম মেয়েমানুষ রাখা? ছাগলকে দিয়ে যব মাড়ানো গেলে লোকে আর গোরু পুষত না।

কিরণময়ী মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, কে বললে সে গেছে?

বাড়িউলী আসিয়া চোখ ঘুরাইয়া বলিল, নাও আর ঢঙ করতে হবে না। কে বললে? আমি হলুম বাড়িউলী, আমাকে আবার বলবে কে গা? নিজে কান পেতে শুনেচি। নইলে কি এতকাল এ-বাড়ি রাখতে পারতুম, কোন্‌কালে পাঁচ-ভূতে খেয়ে ফেলত তা জানো?

কিরণময়ী নীরবে গৃহকর্ম করিতে লাগিল; জবাব না পাইয়া বাড়িউলী নিজেই বলিতে লাগিল, কতদিন থেকে বলচি বৌমা, তাড়াও আপদটাকে। তা না, থাক কোথায় যাবে! আরে, কোথায় যাবে তার আমি জানি কি! অত ভাবতে গেলে ত চলে না। খাও, পরো, মাখো, সোনা-দানা গায়ে তোলো, সঙ্গে সঙ্গে পীরিতও কর। তা এ কোন্‌ দিশি ছিষ্টিছাড়া পীরিত করা বাছা!

কিরণময়ী একবারমাত্র মুখ তুলিয়াই আবার দৃষ্টি আনত করিল। বাড়িউলী বুঝিল, তাহার বহুদর্শিতার উপদেশাবলী কাজে লাগিতেছে। সতেজে কহিতে লাগিল, আর এই কি বাছা, তোমার পিরিত করবার সময়? সোমত্ত মেয়েমানুষ, এখন শুধু দু’হাতে লুটবে। তার পর দু’পয়সা হাতে করে নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে ভারী বয়সে পীরিত করো না, কে তোমাকে মানা করচে! হাতে পয়সা থাকলে কি ছোঁড়ার অভাব? কত গণ্ডা চাই? দু’পায়ে যে তখন জড়ো করে উঠতে পারবে না।

কিরণময়ী বিমনা হইয়াছিল,—কি জানি সব কথা তাহার কানে গেল কি না। কিন্তু সে কোন কথা কহিল না।

বাড়িউলীর নিজের ঘরের কাজ তখনও বাকী ছিল। তাই আর দেরী করিতে না পারিয়া দুপুরবেলায় পুনরায় আসিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া প্রস্থান করিল।

এ বাটীর সকলেই প্রায় কারখানায় চাকরি করে। সকালে কাজে যায়, দুপুরবেলা খাইবার ছুটি পাইয়া ঘরে আসে এবং স্নানাহার সারিয়া পুনরায় কাজে গিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে সেদিনের মত অবসর পায়।

আজও সকলে কাজ চলিয়া গেলে বেলা দুটো-আড়াইটার পর বাড়িউলী আসিয়া পুনরায় দরজার কাছে দাঁড়াইল। স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, খাওয়া হলো বৌমা? কি রাঁধলে?

কিরণময়ী আজ উনানে আগুন পর্যন্ত দেয় নাই, তথাপি বাড়িউলীর প্রশ্নে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ হয়েচে। এসো, বসো।

বাড়িউলী দরজার কাছে আসন গ্রহণ করিল। সে ঘরে ঢুকিয়াই বুঝিয়াছিল কিরণময়ীর মন ভাল নাই, তাই সহানুভূতির স্বরে কহিল, তা হবে বৈ কি বাছা, দু’দিন মনটা খারাপ হবে। একটা পশু-পক্ষী পুষলে মন কেমন করে, তা এ ত মানুষ। যেমন করে হোক, ছ-সাতটা মাস ঘর-সংসারও ত করতে হয়েচে! তা ঐ দুটো দিন—তিন দিনের দিন আর কেউ নাম-গন্ধও করে না বৌমা, চোখের ওপর কত গণ্ডা দেখলুম।

কিরণময়ী জোর করিয়া একটু হাসিয়া কহিল, সে ত সত্যিই।

বাড়িউলী চোখ-মুখ ঘুরাইয়া তৎক্ষণাৎ প্রতিধ্বনি করিল, সত্যি নয়? তুমিই বল না বাছা, সত্যি নয় কি! আবার নতুন মানুষ আসুক, নতুন করে আমোদ-আহ্লাদ কর,—বাস্‌, সব শুধরে গেল। কি বল, এই নয়?

কিরণময়ী ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল বটে, কিন্তু এই গায়ে-পড়া আলাপে ক্রমশঃ চিত্ত তাহার উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া উঠিতেছিল।

অকস্মাৎ বাড়িউলী চোখ-মুখ কুঞ্চিত ও গলা খাটো করিয়া কহিল, ভাল কথা মনে পড়েচে বৌমা, খোট্টা মিন্‌সেকে ত সকালেই খবর পাঠিয়েছিলুম। ব্যাটার আর তর্‌ সয় না, বলে, লোকজন কাজে বেরিয়ে গেলে দুপুরবেলাতেই আসব। কি জানি, এখুনি এসে পড়বে নাকি—

কিরণময়ী সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল—এখানে কেন?

বাড়িয়ালী কথাটাকে অত্যন্ত কৌতুকের মনে করিয়া কৃত্রিম ক্রোধের ছলে কহিল, আ মর্‌ ছুঁড়ি, সে আসবে না ত কি তুই সেখানে যাবি নাকি? তোর কথা শুনলে যে হাসতে হাসতে পেটের নাড়ী ছিঁড়ে যায়। বলিয়া শুষ্ক হাসির ছটায় ঢলিয়া একেবারে কিরণময়ীর গায়ের উপর গিয়া পড়িল।

0 Shares