চরিত্রহীন

সুরবালা নিজের কথায় ব্যথিত হইয়া সান্ত্বনার স্বরে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, কেন পসার হবে না, খুব পসার হবে। তবে, একটু দেরী হতে পারে, এই যা। কিন্তু তাও বলি, তোমার পসারের দরকারই বা কি? হাসিয়া বলিল, বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত আমার সামনে হাজির থাকলে আমি তোমাকে পাঁচ শ’ টাকা করে দিতে পারি। বাবা আমাকে মাসে মাসে ত আড়াই শ’ টাকা দেন, আরো আড়াই শ’ টাকা না হয় চেয়ে নেব!

উপেন্দ্র বলিলেন, তা যেন নিলে; কিন্তু আমাকে করতে হবে কি? বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

সুরবালা বলিল, হাঁ। আর নিতান্ত দাঁড়াতে না পারলে, না হয় বসো।

আর নিতান্ত বসতে না পারলে না হয় শোবো? কি বল?

সুরবালা মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, না, শুতে পাবে না। বসতে না পারলে আবার দাঁড়াতে হবে। হাকিমের সামনে বেয়াদপি করলে তোমার ফাইন হবে।

ফাইন দিতে না পারলে?

আটক থাকতে হবে। চারটের পরেও বের হতে পাবে না– বুঝেছ?

উপেন্দ্র মাথা নাড়িয়া বলিলেন, বুঝেছি–হাকিম কিছু কড়া–চাকরি বজায় রাখতে পারলে হয়।

সুরবালা তাহার দুটি কোমল বাহুদ্বারা স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া বলিল, হাকিম কড়া নয় গো, কড়া নয়। চাকরি তোমার বজায় থাকবে–একটি দিন শুধু পরীক্ষা করেই দেখ না। ক্ষণকাল পরে সুরবালা নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, বাবার চিঠির জবাব দেবে?

উপেন্দ্র কহিলেন, খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন নেই, পাত্র আপনি হাজির হবে—এই জবাব দেব।

ছিঃ, ও কি কথা! তাঁর সঙ্গে কি তামাশা চলে?

এতক্ষণ তবে কি তুমি আমার সঙ্গে তামাশা কচ্ছিলে?

সুরবালা অপ্রতিভ হইয়া বলিল, দেখ, তামাশা করিনি, কিন্তু বাবাকে এ কথা লেখবার দরকার নেই। সত্যিই আমি বিশ্বাস করি শচীর পাত্র ঠিক হয়েই আছে এবং সে ছাড়া তার অন্য পথও নেই, কিন্তু তোমার মুখে ও- কথা শুনলে বাবা রাগ করবেন।

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, সত্যিই শচীর পাত্র ঠিক হয়ে আছে। তাকে আমিও জানি, তুমিও জানো।

সুরবালা উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে বল না?

উপেন্দ্র বলিলেন, এখন না। সব ঠিক করে তবে তোমাকে জানাব।

সুরবালা ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিল, আচ্ছা। কিন্তু একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি—শচীর একটু দোষ আছে, সেই দোষটুকু গোপন করে পাত্র স্থির করা উচিত নয়। তাতে ফল ভাল হবে না।

উপেন্দ্র উদ্বিগ্ন হইয়া প্রশ্ন করিলেন, দোষ আবার কি?

সুরবালা বলিল, বলছি। বাবার ইচ্ছে বোধ হয় ওইটুকু দোষ গোপন রাখা। না হলে তিনি নিজেই তোমাকে জানাতেন। শচী দেখতে-শুনতে লেখাপড়ায় ভালই, বাবার টাকাও আছে সত্যি, কিন্তু শচীকে কি তুমি ভাল করে দেখনি?

উপেন্দ্র বলিলেন, দেখেছি, কিন্তু ভাল করে দেখবার সাহস—

পায়ে পড়ি তোমার। আগে আমার কথা শোন, তারপর যা খুশী বলো। তুমি ত জানই, শচী ছেলেবেলা থেকে রোগা। দু-তিনবার ভারী ভারী ব্যামোতে মরতে মরতে বেঁচেছে।তারি একবার ব্যারাম সেরে গেল, কিন্তু বাঁ পা আগাগোড়া ফুলে পেকে উঠল। ডাক্তার অস্ত্র করে তাকে বাঁচালেন বটে, কিন্তু পা আর সোজা হলো না। সেই অবধি একটু খুঁড়িয়ে চলে। ডাক্তার বলেছিলেন, বয়স হলে সেরে যেতেও পারে, কিন্তু এই আশ্বাসের উপর বিশ্বাস করে কে বিয়ে করতে সম্মত হবে? যে সত্যিই ভাল ছেলে, তার ভাল মেয়েও জুটবে—জেনেশুনে সে শচীর মত মেয়েকে বিয়ে করবে না। আর যে শুদ্ধমাত্র টাকার লোভে রাজী হবে সে অসৎ পাত্র।

উপেন্দ্র স্থির হইয়া শুনিয়া বলিলেন, আমি ত শচীকে অনেকবারই দেখেছি, কিন্তু কোনদিন খুঁড়িয়ে চলতে ত দেখিনি।

সুরবালা মৃদু হাসিয়া কহিল, পুরুষেরা কোন্‌ জিনিসটা দেখতে পায়! কিন্তু মেয়েদের চোখকে ত ফাঁকি দেওয়া চলবে না—তারা চক্ষের নিমেষে দোষ ধরে ফেলবে।

উপেন্দ্র বলিলেন, কিন্তু তার ত মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে না যে, মেয়েদের চোখকে ভয় করতে হবে!

সে কি কথা! ঠকিয়ে বিয়ে দেবার ইচ্ছে থাকলে ত কানা মেয়েরও বিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু পরে?

উপেন্দ্র ভাবিতেছিলেন, কথা কহিলেন না।

সুরবালা পুনরায় বলিল, গত পূজার সময় আমাদের বক্সারের বাড়িতে ঠিক এই রকম কথাই হয়েছিল। পিসিমা ও মা দুইজনেই বলেছিলেন যে, বিয়ের আগে এ-সব আলোচনার প্রয়োজন নেই। হয়ে গেলে জামাইকে বলে দিলেই হবে।

উপেন্দ্র বলিলেন, বেশ ত।

বেশ নয়, আমি এই কথাই বলি। আমি বলি যে, শাশুড়ী-ননদকে বাদ দিয়ে একলা জামাই নিয়ে চলে না। শচীর যে স্বামী হবে, সে ওকে ভালবাসবেই, কিন্তু তুচ্ছ একটা খুঁত নিয়ে প্রথমেই যদি ও তাদেরী বিদ্বেষের চোখে পড়ে যায় ত কোনদিন সুখে ঘরকন্না করতে পারবে না।

উপেন্দ্র বলিলেন, পারবে। কেননা, দিবাকর তোমার বোনকে অযত্ন করতে পারবে না, তুমি কিংবা দিদিও শচীকে গঞ্জনা দেবে না।

কথা শুনিয়া সুরবালা অবাক হইয়া গেল। অনেকক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া থাকিয়া বলিল, তবে কি ঠাকুরপোর সঙ্গে বিয়ে?

উপেন্দ্র বলিলেন, হাঁ।

কিন্তু বাবা ত রাজী হবেন না।

কেন?

ওর মা-বাপ নেই, বাড়ি-ঘর নেই-এক কথায় কিছুই নেই যে!

উপেন্দ্র সংক্ষেপে বলিলেন, সব আছে, কেননা, আমি আছি।

0 Shares