চরিত্রহীন

সুরবালা কহিল, তবুও বাবা সম্মত হবেন না।

উপেন্দ্র কঠিন হইয়া বলিলেন, আর তুমিও হবে না এইটেই বোধ করি আসল কথা!

সুরবালা চুপ করিয়া রহিল।

উপেন্দ্রও ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া হঠাৎ অপরদিকে পাশ ফিরিয়া অত্যন্ত নীরসকণ্ঠে বলিলেন, আচ্ছা, রাত অনেক হলো-এখন ঘুমোও।

সে রাত্রে অনেক রাত্রি পর্যন্ত সুরবালা জাগিয়া রহিল। হঠাৎ একসময়ে যখন তাহার নিশ্চয় বোধ হইল স্বামী নির্বিঘ্নে নিদ্রা যাইতেছেন, তখন দুই চক্ষে তপ্ত অশ্রু তাহার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। স্বামীর অসীম স্নেহে সে সন্দিহান নহে, কিন্তু কাঁদিতে কাঁদিতে এই কথাই ভাবিতে লাগিল যে, এ সাত-আট বৎসরের ঘনিষ্ঠ মিলনেও কেন সে এই লোকটির অন্ত পাইল না। প্রথম প্রথম অনেকবার সে মনে করিয়াছে যে, এই খামখেয়াল লোকটির মেজাজের কিছুই ঠিক নাই। কখন কি হেতু যে ইহার রাগ হইয়া পড়ে জানিবার বা বুঝিবার জো নাই, কিন্তু শেষে একসময়ে জিজ্ঞাসা করিয়া এটুকু সে বুঝিয়াছিল, ইঁহাকে সম্যক্‌ বুঝিবার ক্ষমতা তাহার কোনদিন হউক বা না হউক, ইহার কোন কাজ বা কথা অহেতুক বা অনিশ্চিত-প্রকৃতি লোকের মত নহে। বিশেষ করিয়া সেইজন্যই দুর্বোধ স্বামীটিকে লইয়া তাহার ভয় ও ভাবনার অন্ত ছিল না। খোঁচা খাইয়া সে যখন-তখন এই দুঃখই করিত, ভগবান তাহার অদৃষ্ট যদি এমন ভালই করিলেন তবে সেই অদৃষ্টকে মানাইয়া চলিবার মত বুদ্ধি তাহাকে দিলেন না কেন? আজিও যতই সে মনে মনে এই কথার আলোচনা করিয়া ভিতরে ভিতরে কারণ খুঁজিয়া ফিরিতে লাগিল, ততই সে নিজের কোন দোষ না পাইয়া হতাশ হইয়া পড়িতে লাগিল। ভগিনীর সম্বন্ধে ভগিনীর এই স্বাভাবিক আশঙ্কা কি কারণে যে দোষাবহ এই কথা সে কোনমতেই ভাবিয়া পাইল না।

বাহিরে শীতের সুদীর্ঘ অন্ধকার রাত্রি স্তব্ধ হইয়া রহিল এবং তাহারি পরিমাণ করিয়া দূরে সরকারী কাছারির ঘণ্টা একে একে বাজিয়া যাইতে লাগিল।

পরিচ্ছেদ – ছয়

পরদিন দ্বিপ্রহরের পরে মহেশ্বরী আহারে বসিলে উপেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া অদূরে মেঝের উপর বসিয়া পড়িল। মহেশ্বরী চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, মেজবৌ, উপীনকে একটা আসন পেতে দাও।

উপেন্দ্র কহিলেন, আসন থাক দিদি। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।

শুনিবার জন্য মহেশ্বরী তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

উপেন্দ্র বলিল, শ্বশুরমশাই শচীর পাত্র ঠিক করবার জন্যে পরশু একখানা জরুরী চিঠি লিখেছেন। তুমি ওদের সমস্ত কথা যত জানো তত আর কেউ জানে না। তাই জিজ্ঞাসা করছি, শচীর দেহে কি কোন দোষ আছে?

মহেশ্বরীর স্বামী ভগ্নস্বাস্থ্য হইয়া শেষদিকে প্রায় চার-পাঁচ বৎসর বক্সারে প্র্যাকটিস করিয়াছিলেন। সেখানে অবস্থিতিকালে সুরবালার পিতারই একটা বাড়ি ভাড়া করিয়া কাছাকাছি ছিলেন বলিয়া উভয় পরিবারে অতিশয় ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়াছিল। সুরবালার বিবাহের সম্বন্ধ মহেশ্বরীই স্থির করিয়াছিলেন।মহেশ্বরী ক্ষণকাল উপেন্দ্রর মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, পশু কি বলে?

সে বলে, শচী একটু খোঁড়া।

মহেশ্বরী ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, খোঁড়া নয়; তার ছেলেবেলায় অস্ত্র হবার দরুন বাঁ পাটা একটু টেনে চলত—তা এতদিনে বোধ করি সেরে গেছে।

আর দোষ নেই ত?

না।

শুনি ত শ্বশুরমশায়ের অগাধ সম্পত্তি—তোমার কি মনে হয় দিদি?

আমারও ত তাই মনে হয়।

উপেন্দ্র তখন আরও একটু কাছে সরিয়া আসিয়া গলা খাটো করিয়া বলিল, তবে তোমাকে একটা কথা বলি দিদি। শচীরা দুই বোনেই যখন ভবিষ্যতে সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হবে, তখন এত বিষয় বেহাত হতে দেওয়া ত সুবুদ্ধির কাজ নয়।

মহেশ্বরী হাসিমুখে বলিলেন, তা ত নয়; কিন্তু উপায়টা কি শুনি? বলিয়াই হাসিয়া ফেলিলেন।

উপেন্দ্রও হাসিয়া বলিল, হাসি নয় দিদি। পশুকেও ক্ষ্যাপাবার জন্যে এ কথা বলিনি। আমি দিবার কথা মনে করেছি।

শুনিবামাত্রই মহেশ্বরীর মুখ কালি হইয়া গেল। তিনি দিবাকরকে দেখিতে পারিতেন না। তীক্ষ্ণদৃষ্টি উপেন্দ্র তাহা দেখিতে পাইয়াও বলিল, কি বল দিদি?

মহেশ্বরী নতমুখে চিন্তার ভান করিয়া ভাত মাখিতেছিলেন, মুখ তুলিয়া হাসি টানিয়া আনিয়া বলিলেন, বেশ ত।

উপেন্দ্র কহিল, শুধু বেশ হলে ত চলবে না দিদি, এ কাজ তোমারি! পশুর বিয়ে তুমিই দিয়েছিলে, এখন সে বলে, তার মত ভাগ্যবতী যেন সবাই হয়। আমার বিশ্বাস, তুমি যাতে হাত দেবে তাতেই সোনা ফলবে।

মহেশ্বরী চিন্তিত-মুখে কহিলেন, কিন্তু শচীর একটু খুঁত আছে যে!

উপেন্দ্র কহিল, আছে বলেই ত তোমাকে হাত দিতে বলছি। তোমার পুণ্যে সমস্ত নিখুঁত হয়ে যাবে।

উপেন্দ্রর কথায় মহেশ্বরীর চিত্ত ক্রমশঃ আর্দ্র হইয়া আসিতেছিল, বলিলেন, কিন্তু উপীন, দিবাকরের মেজাজ বুঝতে পারিনে। বাড়ির মধ্যে থেকেও সে যে বাড়ি-ছাড়া পর। সেইজন্যেই ভয় হয়, পাছে ওইটুকু খুঁত নিয়ে শেষে একটা মস্ত অ-সুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এক কথা—দিবাকর কি রাজী হবে?

কেন হবে না দিদি! এ সংসারে তার আপনার বলতে কিছুই নেই। সমস্তই যাকে নিজের হাতে না করলে মাথা গুঁজে দাঁড়াবার জায়গা হবে না, তার এ সুবিধে ত্যাগ করা শুধু বোকামি নয়—পাপ।

0 Shares