চরিত্রহীন

পরীক্ষার ভয় চাবুকের মত যতবার তাহাকে ফিরাইয়া আনিয়া পাঠে নিযুক্ত করিল, ততবারই সে উধাও হইয়া গিয়া আর একদিকে স্বপ্ন রচনা করিতে লাগিল। বহুক্ষণ অবধি এই বিদ্রোহী মনের পিছনে ছুটাছুটি করিয়া কিছুই না করিতে পারিয়া দিবাকর অনুতাপ করিতে লাগিল যে, তাহার সময় বৃথা নষ্ট হইয়া যাইতেছে। কিন্তু কি অভূতপূর্ব পরিবর্তন! কিসের নেশা যে তাহাকে অকস্মাৎ এমন মাতাল করিয়া তুলিয়াছে, তাহার হেতু খুঁজিতে গিয়াই যে কথা মনে আসিল, অত্যন্ত লজ্জার সহিত দিবাকর তাহার প্রতিবাদ করিয়া দৃঢ়ভাবে এই কথা বলিল যে, ইহাতে তাহার সম্পূর্ণ অনিচ্ছা এবং একান্ত বিতৃষ্ণা। যদি পূজনীয় কাহারো মন এবং মান রক্ষা করিতেই হয় ত নিতান্ত উদাসীনের মতই করিবে। এই বলিয়া দ্বিগুণ আগ্রহের সহিত উচ্চকণ্ঠে পড়িতে আরম্ভ করিয়া দিল। কিন্তু মনকে আজ সংযমে রাখা শক্ত। সে যে খেলার মাঝখান হইতে চলিয়া আসিতেছে, যে আকাশ কুসুমের অর্ধেক গাঁথা মালা ফেলিয়া রাখিয়া জবরদস্তি পড়া মুখস্থ করিতেছে তাহা সম্পূর্ণ করিবার সুযোগ অনুক্ষণ খুঁজিয়া ফিরিতে লাগিল। তা ছাড়া এই যে কল্পনার বসন্ত বাতাস এইমাত্র তাহার দেহ স্পর্শ করিয়া গিয়াছে, সে স্পর্শ কি মধুর! তাহার চতুর্দিকে যে সৌন্দর্য-সৃষ্টি চলিতেছিল—সে কি সুন্দর! সূর্যের দিকে মুখ তুলিয়া চক্ষু বুজিলেও যেমন আলোকের সঞ্চার বিচিত্র বর্ণে অনুভূত হইতে থাকে, পড়া তৈরির একান্ত চেষ্টার মধ্য দিয়াও অস্পষ্ট মাধুর্যের সাড়া তেমনি করিয়া তাহার সমস্ত দেহে ধীরে ধীরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতে লাগিল। কণ্ঠস্বর তাহার মন্দ হইতে মন্দতর, দৃষ্টি তাহার ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসিতে লাগিল এবং এই-সমস্ত ধরপাকড় বাদাবাদির মাঝখানে হঠাৎ এক সময়ে সে নিজেই এই নূতন খেলায় মাতিয়া গেল। তাহার চোখের সুমুখে অসংখ্য আলো, কানের কাছে অগণিত বাদ্য ও মনের মাঝখানে একটা বিবাহের বিরাট সমারোহ অবতীর্ণ হইয়া আসিল; এবং ইহারই কেন্দ্রস্থলে সে নিজেকে বরবেশে কল্পনা করিয়া রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তাহার পরে এ পর্যন্ত যত-কিছু সে শুনিয়াছিল, যাহা-কিছু সে দেখিয়াছিল, ছায়াবাজির মত সমস্তই মনের মাঝখান দিয়া বিচিত্র বর্ণে অসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটিয়া চলিয়া গেল। কোথাও সে স্থির হইতে পারিল না, কিছুই ঠিকমত হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না, শুধু বিস্মিত পুলকে স্বপ্নাবিষ্টের মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল

পরিচ্ছেদ – আট

বিপিনের নিমন্ত্রণ রাখিয়া আসার পরদিন আকণ্ঠ পিপাসা লইয়া সতীশচন্দ্র যখন ঘুম ভাঙ্গিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল, তখন বেলা দশটা। তাহার ঘর তখনও বন্ধ। আজ সকাল হইতেই মেঘমুক্ত আকাশে রৌদ্র অত্যন্ত প্রখর হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছিল, সেই খর-উত্তাপে সমস্ত জানালা-দরজা তাতিয়া উঠিয়া এই রুদ্ধ ঘরের ভিতরটা যে কিরূপ অসহ হইয়াছিল, তাহা এতক্ষণ সে নিজে টের না পাইলেও তাহার সর্বশরীর ইহার জবাবদিহি করিতেছিল।

সমস্ত বিছানা ঘামে ভাসিয়া গিয়াছে এবং সমস্ত অন্তরিন্দ্রিয় জলের অভাবে উন্মত্তের মত হাহাকার করিতেছে। এমনিধারা দেহ-মন লইয়া সতীশচন্দ্র ভগবানের নূতন দিনের মধ্যে সচেতন হইয়া উঠিয়া বসিল, এবং ব্যস্ত হইয়া শিয়রের জানলাটা খুলিয়া ফেলিতেই এক ঝলক রৌদ্র তাহার মুখের উপর গায়ের উপর পড়িয়া যেন তাহাকে একমুহহূর্তে দগ্ধ করিয়া দিয়া গেল।

সমস্ত রাত্রি মাতামাতি করিয়া বেলা দশটায় ঘুম ভাঙ্গার গ্লানি মাতালেই জানে। এই গ্লানি পরিপাক করিয়া সতীশ, বেহারী বেহারী, করিয়া ডাকিতে লাগিল। বেহারী ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল।

সতীশ বলিল, শিগগির এক গ্লাস জল আন ত রে!

বেহারী প্রশ্ন করিল, তামাক দিতে হবে না?

না, জল আন।

চান করবেন না?

এখন না, তুই জল আন।

বেহারী তথাপি গেল না, কহিল, আহ্নিকের—

আহ্নিকের ইঙ্গিতে সতীশ আগুন হইয়া ধমক দিয়া উঠিল, পাজী কোথাকার, তোর অত খোঁজ কেন? যা, জল আন গে!

ধমক খাইয়া বেহারী জল আনিতে নীচে নামিয়া গেল। রান্নাঘরের বারান্দায় বসিয়া সাবিত্রী সুপারি কুচাইতেছিল, স্মিতহাস্যে জিজ্ঞাসা করিল, সতীশবাবু তামাক দিতে বললেন?

বেহারী মুখ ভার করিয়া কহিল, না, জল চাই।

স্নান করলেন না, আহ্নিক করলেন না—জল কি হবে?

বেহারী বিরক্ত হইয়া বলিল, আমি তার জানি কি! হুকুম হলো জল চাই, নিয়ে যাচ্চি।

সাবিত্রী জাঁতি রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আচ্ছা, আমিই নিয়ে যাচ্ছি—তুমি খানিকটা বরফ কিনে আনো গে।

বেহারী পয়সা লইয়া বরফ কিনিতে গেল।

সাবিত্রী উপরে উঠিয়া গিয়া কহিল, যান, চান করে আসুন, আমি ততক্ষণ আহ্নিকের জায়গা করে রাখি।

সতীশ মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল, বেহারী কোথায়?

সাবিত্রী হাসি চাপিয়া বলিল, সে বরফ কিনতে গেছে। বাবু, দোষ করে শাস্তি নেওয়া ভাল—তাতে প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়। আপনি সন্ধ্যে-আহ্নিক না করে কোনও দিন কি জল খান যে, আজ জলের জন্যে হাঙ্গামা কচ্ছেন? যান, দেরী করবেন না।

সাবিত্রীর কাছে প্রতিবাদ নিষ্ফল বুঝিয়া সতীশ উঠিয়া পড়িল এবং তোয়ালে কাঁধে ফেলিয়া স্নান করিতে নামিয়া গেল।

0 Shares