চরিত্রহীন

বাহিরে যে বেলা পড়িয়া আসিতেছিল, ঘরের মধ্যে সতীশের হুঁশ ছিল না। সহসা বাসায় প্রত্যাগত কেরানীদের শব্দ-সাড়ায় সে চকিত হইয়া জানালার বাহিরে উঁকি মারিয়াই বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল এবং তৎক্ষণাৎ একটা পিরান গায়ে দিয়া চাদর কাঁধে ফেলিয়া অলক্ষিতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। এখনি হাত-মুখ ধুইবার প্রস্তাব লইয়া সাবিত্রী আসিয়া পড়িবে এবং খাবার জন্য জিদ করিতে থাকিবে। আজ তাহার কিছুমাত্র ক্ষুধা ছিল না; কিন্তু সাবিত্রী সে কথা কোনমতে বিশ্বাস করিবে না, অনুরোধ করিবে, পীড়াপীড়ি করিবে, হয়ত বা শেষে রাগ করিয়া চলিয়া যাইবে। এই-সমস্ত মৌখিক স্নেহের বাগ্‌বিতণ্ডা হইতে তাহার জীবনে আজ এই প্রথম সে নিজকে অকৃত্রিম ঘৃণার সহিত দূরে সরাইয়া লইয়া গেল।

পথে ঘুরিতে ঘুরিতে সন্ধ্যার প্রাক্কালে দর্জিপাড়ার একটা গলির মোড়ে হঠাৎ পিছনে পরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনিতে পাইল—ছোটবাবু না?

সতীশ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, হ্যাঁ, মোক্ষদা নাকি?

মোক্ষদা বহুদিন পূর্বে তাহাদের পশ্চিমের বাড়িতে দাসীর কাজ করিত, ছুটি লইয়া কলিকাতায় আসিয়া আর ফিরিতে পারে নাই। বলিল, হাঁ বাবু, আমি। ছোটবাবু, আমার একখানা চিঠি পড়ে দেবেন?

সতীশ হাসিমুখে বলিল, এতবড় শহরে একখানি চিঠি পড়িয়ে নেবার আর কি লোক পেলে না ঝি? কৈ, চিঠি কোথায়?

ঝি বলিল, চিঠিখানি আমার ঘরে আছে বাবু। সাহস করে অচেনা লোককে দিয়ে পড়াতে পারিনি, পাছে আর কিছু বা থাকে। তবে আমাদের বাড়িতেই একটি মেয়ে আছে, সে লিখতে পড়তে জানে, কিন্তু তাকেও আজ দু’দিন ধরে পাচ্চিনে, এত রাত্তির করে বাড়ি ফেরে যে তখন আর সময় হয় না।

সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, বাড়ি তোমার কত দূরে?

ঝি বলিল, এখান থেকে একটু দূর পড়ে বৈ কি! বড় রাস্তার ওধারে একটা গলির মধ্যে। বাবু, যদি আপনার ঠিকানাটা বলে দেন, তা হলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে আমি না হয় কালই যাই, চিঠিটা পড়িয়ে আনি।

আচ্ছা, বলিয়া সতীশ তাহার শোভাবাজারের ঠিকানাটা বলিয়া দিল, এবং কোথা দিয়া কেমন করিয়া যাইতে হয়, বুঝাইয়া বলিতে বলিতে পথ চলিতে লাগিল। কতক্ষণ আসার পরে ঝি এক জায়গায় হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, বলতে সাহস পাইনে বাবু, যদি একবার পায়ের ধূলা দেন, ঘর আমার এখান থেকে আর বেশী দূরে নয়।

সতীশ ক্ষণকাল কি ভাবিয়া বলিল, আচ্ছা চল।

তাহার আজ বাসায় ফিরিতে একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। পথে পথে ঘুরিয়া রাত্রি অধিক হইলে, সাবিত্রী ঘরে চলিয়া গেলে বাসায় ফিরিবে, এই সঙ্কল্প করিয়াই সে বাহির হইয়াছিল। তাই, সহজেই সম্মতি দিয়া গোটা-দুই গলি পার হইয়া তাহারা একটা মেটে দোতলা বাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

‘একটু দাঁড়ান’, বলিয়া মোক্ষদা ভিতরে প্রবেশ করিল এবং অনতিবিলম্বে একটা কেরোসিনের ডিবা হাতে লইয়া ফিরিয়া আসিয়া পথ দেখাইয়া উপরে লইয়া গেল। ওধারের কোণের ঘরে একটি ছোট টুলের উপর পিতলের পিলসুজে প্রদীপ জ্বলিতেছিল, সেই ঘরখানি দেখাইয়া দিয়া সবিনয়ে বলিল, একটু বসুন, আমি তামাক সেজে আনি।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া এই ছোট ঘরটির পরিচ্ছন্নতা দেখিয়া সতীশ আরাম বোধ করিল। একধারে একটা জলচৌকির উপর মাজাঘষা কতকগুলি পিতল-কাঁসার বাসন ঝকঝক করিতেছে এবং তাহারই পাশে একটি ছোট আলনাতে কয়েকটি কাপড় গোছান রহিয়াছে। দেওয়ালে ব্রাকেটের উপর একটি টাইমপিস ঘড়িতে আটটা বাজিয়া গেল। সতীশ চৌকাঠের বাহিরে জুতা খুলিয়া রাখিয়া তক্তপোশে পাতা সাদা ধবধবে বিছানাটির উপর গিয়া বসিল এবং ঘরের অন্যান্য আসবাবগুলির মনে মনে পরীক্ষা লইতে লাগিল। প্রথমেই নজর পড়িয়া গেল একটি ছোট শেল্‌ফের উপরে। কতকগুলি বই সাজানো ছিল, সতীশ উঠিয়া গিয়া একখানা সংগ্রহ করিয়া আনিল এবং প্রথম পাতা উলটাইতেই দেখিতে পাইল, ইংরাজী অক্ষরে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নাম লেখা। সে বইখানি রাখিয়া দিয়া আরও তিন-চারিখানি বই খুলিয়া ওই একই নাম দেখিয়া বইগুলি যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল।

মোক্ষদা বাঁধা হুঁকায় তামাক সাজিয়া আনিল।

সতীশ হুঁকা হাতে লইয়া বলিল, ঝির ঘরটি চমৎকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, উঠতে ইচ্ছে করে না।

মোক্ষদা একটুখানি হাসিয়া বলিল, উঠবেন কেন বাবু, বসুন। এ ঘরটি কিন্তু আমার নয়, আর একটি মেয়ের।

সতীশ প্রশ্ন করিল, তিনি কোথায়?

মোক্ষদা বলিল, সে এক বাবুদের বাসায় কাজ করে। আসতে প্রায়ই রাত হয়ে যায়, তাই ঘরের চাবি আমার কাছে থাকে। আমাকে মাসী বলে ডাকে।

সতীশ বলিল, তা ডাকুক, কিন্তু ভুবনবাবুটি আসবেন কখন?

ঝি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ভুবনবাবু আবার কে?

ভুবনচন্দ্র মুখুয্যে—চেনো না?

অকস্মাৎ ঝি ভ্রূ প্রসারিত করিল—ও! আমাদের মুখুয্যেমশাই? না না, তাঁকে আর আসতে হবে না!

কেন, মারা গেছেন নাকি?

মোক্ষদা দুই চক্ষু দৃপ্ত করিয়া বলিল, না, মারা যাননি, কিন্তু গেলেই ছিল ভাল। তিনি বামুনমানুষ, বর্ণের গুরু, আমাদের মাথার মণি, নারায়ণতুল্য। তাঁকে অভক্তি করছি নে, তাঁর চরণের ্ধূলো নিচ্চি; কিন্তু কোনদিন দেখা পেলে তিনটি ঝ্যাঁটা মুখে গুনে মারব, তবে আমার নাম মোক্ষদা।

0 Shares