চরিত্রহীন

সতীশ হাসিয়া উঠিল। বলিল, রাগের মাথায় বামুনমানুষকে যেন অভক্তি করে মেরে বসো না! বেশ ভক্তি করে গুনে গুনে মেরো, তাতে পাপ হবে না। কিন্তু তিনি লোকটি কে?

মোক্ষদা উদ্ধতভাবে বলিয়া উঠিল, লোকটির পরিচয় আর কি দেব বাবু, তিনি মানুষ নয়, চামার। এই মেয়েটিকে যে পথে বসিয়ে গেলি বাপু, এই কি তোর আপনার লোকের কাজ হলো? ছি ছি, গলায় দেবার দড়ি জুটল না!

সতীশ অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল, কে তিনি? কি করেছেন তিনি?

হঠাৎ দ্বারের বাহির হইতে জবাব আসিল, লোকটিকে আপনি চেনেন না, কি হবে আপনার তাঁর কথা শুনে?

সতীশ চমকিয়া উঠিল।

মোক্ষদা মুখ ফিরাইয়া কহিল, সাবি নাকি! কখন এলি তুই?

সাবিত্রী ঘরে ঢুকিয়া বলিল, এইমাত্র আসছি। বাবুটিকে কোথায় পেলে মাসী?

মোক্ষদা কহিল, ইনিই আমাদের ছোটবাবু, সাবিত্রী। আজ দু’দিন হলো বৌমার কাছ থেকে একখানি চিঠি পেয়েছি, তা পড়াতে পাইনি, তাই বললুম বাবু যদি দয়া করে পায়ের ধূলো দেন।

সাবিত্রী বলিল, তবে পায়ের ধূলো তোমার ঘরে না দিয়ে আমার ঘরে কেন?

মোক্ষদা ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, তা রাগ করিস কেন সাবি, আমার ঘরে ত ভদ্রলোককে বসানো যায় না, তাই তোর ঘরে বসিয়েছি। কত বড়দরের লোক এঁরা—কোথায় আহ্লাদ করবি, না রাগ করছিস?

সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, রাগ করব কেন মাসী, রাগ নয়। কিন্তু অমনি অমনি পায়ের ধূলো নিলে যে পাপ হয়। কিছু জলযোগ করান উচিত—হাঁ বামুনঠাকুর, আপনার ক্ষিদে পেয়েছে কি?

সতীশ অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বসিয়াছিল, ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

সাবিত্রীর অভদ্র প্রশ্নে বিরক্ত হইয়া মোক্ষদা বলিয়া উঠিল, এ তোর কি-রকম কথার ছিরি সাবিত্রী। ভদ্রলোকের সঙ্গে কি এইরকম করে কথা কইতে হয়?

সাবিত্রী জোর করিয়া হাসি চাপিয়া বলিল, এ আর মন্দ কথা কি মাসী? আচ্ছা, ওঁর ক্ষিদের কথা না হয় আর জিজ্ঞাসা করব না, তুমি কিন্তু দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে আনো, আমি ততক্ষণ জায়গা করে রাখি।

মোক্ষদা অস্ফুটে বকিতে বকিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেলে সাবিত্রী কহিল, কাল রাত থেকেই ত একরকম উপোস চলছে—বিকেলবেলা যে কেমন করে পালিয়ে এলেন তাও টের পেলুম না। এখন উঠুন, সন্ধে-আহ্নিক করে কিছু

খান। ওই আলনার ওপরে কাচা কাপড় আছে, পরে আমার সঙ্গে আসুন—না না, দেরী নয়, উঠুন।

সতীশ মাথা নাড়িয়া বলিল, আমার ক্ষিদে নেই।

সাবিত্রী বলিল, না থাকলেও খেতে হবে। তার প্রথম কারণ, ক্ষিদে নেই এ কথা বিশ্বাস করলুম না, দ্বিতীয় কারণ—

সতীশ মুখের ভাব অত্যন্ত শক্ত করিয়া বলিল, দ্বিতীয় কারণটা মিছে কথা, ওই প্রথমই সব। সমস্ত বিষয়েই তোমার জিদ আর জবরদস্তি। এই জিদের সঙ্গে কারু পারবার জো নেই।

সাবিত্রী মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, তবে মিথ্যে চেষ্টা করা কেন?

সতীশ আরও গম্ভীর হইয়া বলিল, তা নয় সাবিত্রী! আজ আমার চেষ্টা কোনমতেই মিথ্যা হবে না। হয় তোমার

দ্বিতীয় কারণ বলো, না হয় সত্যি বলছি তোমাকে, আমি কোনমতেই এখানে কিছু খাবো না।

সতীশের গোঁ দেখিয়া সাবিত্রী নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বলিল, আমি ভাবছি আজ আপনি এলেন কেন? আজ আমার জন্মদিন তাই, নিজে এসে যখন দাসীর ঘরে পায়ের ধূলো দিয়েছেন, তখন শুধু শুধু আপনাকে ছেড়ে দিতে পারিনে। ‘পারিনে’ বলিয়াই সাবিত্রী হঠাৎ থামিয়া গেলো বটে, কিন্তু তাহার অন্তরের গোপন ব্যথাটা তাহারই কণ্ঠস্বরের মুক্ত পথ ধরিয়া এমনি অকস্মাৎ সতীশের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল যে, কয়েক-মুহূর্তের জন্য সতীশের সমস্ত বোধশক্তি অসাড় হইয়া গেল। বুদ্ধিমতী সাবিত্রী ইহা চক্ষের নিমিষে অনুভব করিয়া তাহার সমস্ত কথাটাকে সহজ পরিহাসে পরিণত করিয়া হাসিয়া বলিল, ভগবান আজ আপনাকে আমার অতিথি করে পাঠিয়েছেন, সুতরাং খেতেও হবে, দক্ষিণাও নিতে হবে,—আজ নিতান্তই জাতটা মারা গেল দেখচি।

এতক্ষণে সতীশের সহজ শক্তি ফিরিয়া আসিল, জিজ্ঞাসা করিল, সত্যিই কি আজ তোমার জন্মদিন?

সাবিত্রী বলিল, সত্যি।

সতীশ বলিল, তবে এমন দিনে যদি এসেই পড়েচি ত দোকানের কতকগুলো বাসী মেঠাই-মণ্ডা খেয়ে পেট ভরাব না। তা ছাড়া ও-সব ত আমি কোনদিনই খাইনে।

সাবিত্রীও তাহা জানিত। মনে মনে লজ্জিত হইয়া বলিল, কিন্তু আজ যে রাত হয়ে গেছে!

সতীশ বলিল, হলোই বা রাত। আজ বাসায় ফিরে গিয়ে ত বকুনি খেতে হবে না যে, রাতকে আজ ভয় করতে হবে। যাই বল তুমি, কোন মতেই আমি ও-সব খাব না।

তোমার সঙ্গে পারবার জো নেই, বলিয়া সাবিত্রী হাসিয়া উঠিয়া গেল।

সতীশ বসিয়া ছিল, শুইয়া পড়িল। এই ক্ষুদ্র কুটীর এবং এই নির্মল শুভ্র শয্যা ছাড়িয়া যাইতে কোনমতেই তাহার

মন উঠিতেছিল না, অথচ, আত্মসম্ভ্রম অক্ষুণ্ণ রাখিয়া বসিয়া থাকিবারও কোনও সদুপায় ছিল না। এখন, এই খাবার তৈরির বিলম্বের সম্ভাবনা তাহাকে যেন একটা আসন্ন কর্তব্যের কঠিন দায় হইতে অব্যাহতি দিয়া গেল।

সে পাশবালিশটা জোর করিয়া জড়াইয়া ধরিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। চলিয়া যাইবার সময় সাবিত্রী বাহির হইতে শিকল তুলিয়া দিয়া গিয়াছিল, ইহাও যেমন সে টের পাইয়াছিল, তাহার ‘তুমি’ সম্ভাষণও সে তেমনি লক্ষ্য করিয়াছিল। নির্জন ঘরের মধ্যে এই নবলব্ধ তথ্য দুটি, যাদুকর ও তাহার মায়াকাঠির মত তাহার মনের মধ্যে অপূর্ব ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করিয়া চলিতে লাগিল। আজই দুপুরবেলা যে-সমস্ত ভালবাসার আবর্জনা তাহার মনের ভিতর হইতে ভাটার টানে বাহিরের দিকে ভাসিয়া গিয়াছিল, জোয়ারের উলটা স্রোতে আবার তাহারা একে একে ফিরিয়া আসিয়া দেখা দিতে লাগিল। আজই দুপুরবেলায় আত্মাভিমানের আঘাতের সুতীব্র জ্বালা নিজের মনের নীচ প্রবৃত্তির দিকে তাহার চোখ খুলিয়া দিয়াছিল, জ্বালার উপশমের সঙ্গে সঙ্গেই সে চক্ষু আপনি মুদ্রিত হইয়া গেল। এমনি করিয়া নিজেকে লইয়া খেলা করিতে করিতে একসময়ে বোধ করি সে একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ দ্বার খোলার শব্দে জাগিয়া উঠিয়া পাশ ফিরিয়া দেখিল সাবিত্রী মোক্ষদাকে লইয়া ঘরে ঢুকিতেছে। মোক্ষদা চিঠিখানি সতীশের হাতে দিয়া বলিল, দেখুন ত বাবু, বৌমা কি লিখেচেন?

0 Shares