চরিত্রহীন

হিম কোথায় বাবু, বলিয়া সেইখানেই বেহারী গায়ের কাপড়টা মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, রাত কত হলো রে?

বেশী হয়নি বাবু, বোধ করি দশটা বেজেছে।

সতীশ আবার মৌন হইয়া রহিল। কতক্ষণ পরে মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, তুই সাবিত্রীদের ঘর চিনিস না বেহারী?

বেহারী উঠিয়া বসিয়া বলিল, চিনি বৈ কি বাবু। কতদিন তাকে পৌঁছে দিয়েছি।

সতীশ আর কিছু বলিতে পারিল না। কিন্তু বেহারী বলিল, একবার গিয়ে দেখে আসব কি?

এবারে সতীশ ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, না না, তুই যাবি কোথা? সে যে অনেক দূর!

বেহারী কহিল, দূর কিছুই নয় বাবু।

সতীশ ভাবিতে লাগিল, কথা কহিল না।

বেহারী আস্তে আস্তে বলিল, বাবু, যদি ঘণ্টা-খানেকের ছুটি দেন ত দেখে আসি। সকালবেলা আসেনি, বোধ হয় অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকবে।

তথাপি সতীশ কথা কহিল না।

বেহারী মনে মনে অস্থির হইয়া উঠিল। আজ সমস্ত দিন ধরিয়া সে অভ্যাসমত কথা বলিতে পায় নাই, উপরন্তু, বলিবার বিষয় ইতিমধ্যে এত বেশী সঞ্চয় হইয়া উঠিয়াছে, তাই আর একবার বলিল, নতুন জায়গায় ঘুম আসছে না বাবু, আর একবার তামাক সেজে দেব কি?

সতীশ অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, সাড়া দিল না। তবুও বেহারী কিছুক্ষণ উদ্‌গ্রীব হইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল, শেষে হতাশ হইয়া গায়ে কাপড়টা আর একবার টানিয়া সেইখানেই অবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িল।

পরদিন ঠিক সময়ে সতীশ স্কুলে চলিয়া গেল। মধ্যাহ্নে বেহারী হাতের কাজকর্ম সারিয়া লইয়া সদ্য নিযুক্ত পাঁড়েঠাকুরের উপর বাসার খবরদারির ভার দিয়া বাহির হইয়া পড়িল, এবং সতের দিনের মাহিনা আদায়ের অছিলায় পুরাতন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। অথচ, তাহার এ ভয় ছিল, পাছে রাখালবাবু কোনগতিকে অফিসে না গিয়া থাকেন। তাই ঘরে ঢুকিয়াই নূতন ভৃত্যটার নিকটে সংবাদ জানিয়া লইয়া নির্ভয়ে রান্নাঘরের সম্মুখে আসিয়া গলা বড় করিয়া ডাক দিল, ঠাকুরমশাই, প্রাতঃপ্রেণাম হই।

ঠাকুরমশাই গাঁজা খাইয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া চোখ বুজিয়া ধ্যান করিতেছিলেন, চমকাইয়া উঠিয়া বলিলেন, কল্যাণ হোক! তার পর মাথা সোজা করিয়া চোখ চাহিয়া বলিলেন, ও কে, বেহারী! আয় বোস।

বেহারী কাছে আসিয়া পদধূলি লইয়া বসিল। চক্রবর্তী গামছার খুঁট খুলিয়া খানিকটা গাঁজা বাহির করিয়া বেহারীর হাতে দিয়া বলিলেন, ও-বাসায় তা হলে রাঁধচে কে?

বেহারী উঠিয়া গিয়া হাতের তেলোয় ফোঁটা কয়েক জল লইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, একটা খোট্টা বামুন। একেবারে জানোয়ার!

চক্রবর্তী খুশী হইয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ভগবান ওদের ল্যাজ দিতে ভুলেছেন তাই যা! তাহার পরে বাসার নূতন হিন্দুস্থানী চাকরটাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আমাদের এখানে কালই এক ব্যাটা ভূতকে ধরে আনা হয়েছে, তা সে—বিদ্যে ওর—তার সাক্ষী দ্যাখ না বেহারী, আজ সকালে এক কলকে বার করে দিয়ে বললুম, কৈ তৈরী কর দেখি বাপু! মনে করলুম, বিদ্যেটা একবার দেখিই না। তা বললে বিশ্বাস করবি নে বেহারী ব্যাটা জিনিসটাকেই মাটি করে ফেললে। তা তোদের ওখানে কষ্ট হবে না, সাবিত্রী আমার চালাক মেয়ে, দু’দিনেই শিখিয়ে-পড়িয়ে তালিম করে নেবে।

তাঁহার নিজের পনের আনা বিদ্যাও যে ঐ গুরুর কাছেই শেখা, সে-কথাটা চাপিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন, কিন্তু তাও বলি বেহারী, হাঁড়ি ধরলেই হয় না, বাবুভায়াদের খুশী করা, তাঁদের পাতে রান্না তুলে দেওয়া, বড় সামান্য বিদ্যে নয়—বাম্‌নায়ের জোর চাই! ও খোট্টা-মোট্টার কর্মই নয়। কিন্তু আমার এখানে কাজ করা আর পোষাবে না, সে তোকে আগে থেকেই বলে রাখলুম। তুই বলিস দেখি আমার নাম করে সাবিত্রীকে। সে তখনি বলবে, যাও বেহারী, চক্রবর্তীকে ডেকে আনো, না হয় দু’টাকা মাইনে বেশী নেবে। সতীশবাবু কিন্তু কখখনো না বলবেন না। তাঁর মেজাজ জানি ত। বিশেষ ব্রাহ্মণস্য ব্রাহ্মণ গতিং। আমি দু’টাকা বেশী পেলে সে কিছু আর অপাত্রে পড়বে না, বলিয়া চক্রবর্তী নিজেই হাসিতে লাগিলেন।

বেহারী অবাক হইয়া রহিল। ক্ষণকাল পরে বলিল, ঠাকুরমশাই, সাবিত্রী ত ওখানে নেই।

চক্রবর্তী অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা নেই নেই! তুই আমার নাম করে বলিস, তার পরে যা হয় আমি দেখে নেব।

বেহারী মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া বাঁ হাতের পদার্থটা ডান হাতে লইয়া কহিল, ছুঁয়ে দিব্যি করে বলচি দেব্‌তা, সে ওখানে যায়নি।

চক্রবর্তী এতবড় শপথের পরে আর সন্দেহ করিতে পারিলেন না; রীতিমত আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, তুই বলিস কি বেহারী! সে ত এখানেও আসেনি! তবে চব্বিশ ঘণ্টা রাখালবাবু সতীশবাবু বেচারাকে যে—আচ্ছা, তুই যা—একবার তাকে দেখে আয়, তার পরে আমি আছি আর রাখালবাবু আছেন। আমাকে সে-বামুন পাসনি বেহারী!

তাঁহার ব্রাহ্মণত্বে বেহারীর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল, সে কলিকাটি চক্রবর্তীর হাতে তুলিয়া দিয়া প্রশ্ন করিল, আচ্ছা সতীশবাবুই বা গেলেন কেন? তিনি বলেন, ইস্কুল দূর পড়ে—এটা কিন্তু কাজের কথাই নয়।

চক্রবর্তী সাবধানে আগুন তুলিতে তুলিতে বলিলেন, না, ভেতরে কথা আছে। অতঃপর দুজনে মিলিয়া কলিকাটি নিঃশেষ করিয়া বেহারী উঠিয়া পড়িল এবং উদ্বিগ্নমুখে সাবিত্রীর ঘরের অভিমুখে চলিয়া গেল। তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল সাবিত্রীর অসুখ হইয়াছে।

0 Shares